মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা, বাড়বে সংসার খরচ
প্রকাশিত:
৩ জুন ২০২৫ ১০:৪৫
আপডেট:
৬ জুন ২০২৫ ০১:২৩
-6.jpg.jpg)
মূল্যস্ফীতির কশাঘাত থেকে রেহাই দিতে অন্তর্বর্তী সরকার বাজেটে পদক্ষেপ নেবে-এমন আশা ছিল মধ্যবিত্তের। সেই আশায় গুড়েবালি, অর্থ উপদেষ্টা হাঁটলেন সেই পুরোনো পথেই। কর হার বাড়িয়ে-কমিয়ে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য পূরণকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি।
ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে বাড়িয়ে দিয়েছেন করহারও। সরকারি কিছু সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্রের বাধ্যবাধকতার শর্ত বাতিল করেছেন। এতে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ভ্যাট হার বাড়িয়ে দেওয়ায় সংসার খরচ বাড়বে মধ্যবিত্তের। অবশ্য বিত্তশালীদের ছাড় দিতে ভোলেননি অর্থ উপদেষ্টা। সম্পদ কর বা সারচার্জে দিয়েছেন বড় ছাড়।
অর্থ উপদেষ্টার প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য আয়করে ছাড় দেননি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ঘোষণা অনুযায়ী করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকাই রেখেছেন। তবে ভবিষ্যতের রূপরেখা দিয়েছেন। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করেছেন। অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে এই সীমা প্রযোজ্য হবে। যদিও পরবর্তী ৩ লাখ টাকা (মোট আয় ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত) আয়ের ওপর ১০ শতাংশ করারোপ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় এটি। আবার শহর-গ্রামাঞ্চলের সব করদাতার ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। বাজেটে স্ল্যাব পরিবর্তন ও করহার বাড়ানোয় মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা বাড়বে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই আয়ের এক-তৃতীয়াংশ কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত। অর্থাৎ তাকে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার ওপর আয়কর দিতে হয়। বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী বার্ষিক মোট আয় সাড়ে ৪ লাখ টাকা হলে ৫ শতাংশ এবং পরবর্তী ৪ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে আয়কর প্রযোজ্য। সে হিসাবে করদাতার আয়করের পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার জন্য ৫ হাজার টাকা এবং পরবর্তী ৩০ হাজার টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে ৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ করদাতার প্রদেয় করের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৮ হাজার টাকা।
বাজেটে করহারসংক্রান্ত পরিবর্তন আনায় এই করদাতাকে বাড়তি আড়াই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। কারণ করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার পাশাপাশি করহার ৫ শতাংশের স্থলে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ করদাতার করযোগ্য আয় থাকছে এক লাখ ৫ হাজার টাকা (৪.৮০ লাখ টাকা-৩.৭৫ লাখ টাকা)। করহার ১০ শতাংশ করায় এই করদাতাকে তখন ১০ হাজার ৫০০ টাকা আয়কর দিতে হবে।
অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। যেমন প্রথম রিটার্ন জমা দেবেন-এমন করদাতাদের জন্য সুখবর রয়েছে। নতুন করদাতাদের আয়ভেদে সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা আয়কর দেওয়ার বিধান যুক্ত হয়েছে আয়কর আইনে। মূলত নতুন করদাতাদের করভার লাঘব এবং কর ভীতি দূর করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব করদাতা প্রথমবার রিটার্ন জমা দেবেন, শুধু তারাই এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকার মধ্যে যে অঙ্কের কর দিতে পারবেন। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমার বাধ্যবাধতা শিথিল করা হয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ, সমবায় সমিতির নিবন্ধন নিতে, ক্রেডিট কার্ড নিতে, ৫ লাখ টাকার বেশি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের হিসাব খুলতে এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মাসিক ১৬ হাজার টাকার বেশি অর্থপ্রাপ্তিসহ মোট ১২টি সেবা নিতে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) সনদ জমা দিলেই চলবে।
আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট খাতে বাজেটে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যার কারণে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। যেমন অব্যাহতির সংস্কৃতির পরিহার করতে রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে দেশীয় ফ্রিজ-এসির দাম বাড়তে পারে। মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনে হ্রাসকৃত ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে। উৎপাদনের ক্যাটাগরিভেদে ২ থেকে আড়াই শতাংশ ভ্যাট বাড়ানোয় দেশে তৈরি মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে। বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী, হাইজেনিক ও টয়লেটসামগ্রী উৎপাদনে ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে এইসব পণ্যের দাম বাড়বে। শেভিং কাজে ব্যবহৃত ব্লেডের দাম বাড়তে পারে। কারণ স্টেইনলেস স্টিলের স্ট্রিপ থেকে প্রস্তুত ব্লেড এবং কার্বন স্টিলের স্ট্রিপ থেকে প্রস্তুতকৃত ব্লেডের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
অনেক মধ্যবিত্তের স্বপ্ন থাকে নিজের বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কেনার। সেই স্বপ্ন পূরণে বাজেট বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বাজেটে রড, এঙ্গেল বার তৈরির প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপের সুনির্দিষ্ট করের পরিমাণ এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া বিলেট-ইনগট সুনির্দিষ্ট কর এবং স্ক্র্যাপ গলানোর রাসায়নিকের ফেরো ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো সিলিকা ম্যাঙ্গানিজের শুল্ক কর বাড়ানো হয়েছে। বিধায় নির্মাণ সামগ্রীর প্রধান উপকরণ রডের দাম বাড়তে পারে। আবার বাসা-বাড়ির মেঝেতে ব্যবহৃত মার্বেল-গ্রানাইট পাথর আমদানির সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে মার্বেল-গ্রানাইটের দাম বাড়তে পারে।
নারী ও শিশুদের বাজেট রুষ্ট করেছে। বাচ্চাদের খেলনার দাম বাড়বে। কারণ স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বাজেটে বিদেশি খেলনার ট্যারিফ মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এতে বিদেশি খেলনার দাম বাড়বে। আবার নারী-শিশুদের পছন্দের চকলেটের দামও বাড়তে পারে। চকলেট আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে বাজেটে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের চকলেটের শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য ৪ ডলার। এটি বাড়িয়ে ১০ ডলার করা হয়েছে। এতে আমদানিকৃত সব ধরনের চকলেটের দাম বাড়তে পারে। নারীর সৌন্দর্যবর্ধনে ব্যবহৃত বিদেশি কসমেটিক্স লিপস্টিক, লিপলাইনার, আইলাইনার, ফেস ক্রিম, ফেস ওয়াশ, ময়েশ্চারাইজার লোশন, মেকআপ ফাউন্ডেশন ও মেকআপ কিটের ন্যূনতম আমদানি মূল্য প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতে এইসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
অবশ্য প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা বিত্তশালীদের ছাড় দিতে ভোলেননি। বড়লোকদের সারচার্জের হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে বিত্তশালীদের কর ভার কমবে। অন্যদিকে বিত্তশালীদের পছন্দের ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর পরিবেশ সারচার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: