8638

03/29/2024 নিয়ন্ত্রনহীন দ্রব্যমূল্য, জনজীবনে নাভিশ্বাস!

নিয়ন্ত্রনহীন দ্রব্যমূল্য, জনজীবনে নাভিশ্বাস!

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনির

৪ মার্চ ২০২২ ০৪:১৫

মানুষের অভাব পূরণ করে, প্রয়োজন মিটায় এমন সব সামগ্রীই সাধারণত দ্রব্য। দ্রব্যকে প্রধানত বস্তুগত ও অবুস্তগত দু'ভাগে ভাগ করা হয়। বস্তুগত দ্রব্য- দেখা, ধরাছোঁয়া গেলেও অবস্তুগত দ্রব্যকে দেখাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। অবস্তুগত দ্রব্যকে সাধারনভাবে সেবা দ্রব্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জীবদেহের শক্তির প্রধান উৎস হল খাদ্য। যে সব আহার্য সামগ্রী গ্রহণ করলে জীবদেহের বৃদ্ধি, পুষ্টি, শক্তি উৎপাদন ও ক্ষয়পূরন হয়, তাই খাদ্য।

খাদ্যের প্রয়োজনে যেসব বস্তুগত দ্রব্যাদি আমরা গ্রহণ বা ক্রয় বা উৎপাদন করে থাকি তাই খাদ্যদ্রব্য। প্রধান খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে যেমন রয়েছে-চাল, ডাল, লবণ, তেল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ইত্যাদি। দৈনন্দিন জীবনে খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য ব্যবহার্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর অপ্রতুলতা ও ক্রয় ক্ষমতার সহজলভ্যতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ রবার্ট গিফেন, দ্রব্য বলতে এমন কিছু সস্তা ও নিকৃষ্ট সামগ্রীকে বুঝান, যা সাধারণত সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা ভোগ করে থাকে। জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় নিকৃষ্ট দ্রব্য যেমন-মোটা চাল, মোটা কাপড় প্রভৃতির দাম বৃদ্ধি পেলে দরিদ্র জনসাধারণ অন্যান্য উৎকৃষ্ট দ্রব্য যেমন- মাছ, মাংস প্রভৃতির ভোগ কমিয়ে দিয়ে চড়া দামের নিকৃষ্ট দ্রব্যগুলি বেশি পরিমাণে ক্রয় করে।

সুতরাং এসব দ্রব্যের ক্ষেত্রে দাম বাড়লে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং দাম কমলে চাহিদা হ্রাস পায়। দ্রব্যমূল্যের ঘাটতি ও ঊর্ধ্বগতি প্রতিনিয়ত বাংলার আকাশে-বাতাসে যেভাবে ধ্বনিত হয়, সেক্ষেত্রে রবার্ট গিফেনের বক্তব্যটি শুধুমাত্র দরিদ্র শ্রেণী নয়, সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের ভোগ্য হিসেবে সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।

বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, শাকসবজি, রান্নার গ্যাস থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অস্বীকার করছি না, মানুষের জীবনযাত্রার মানউন্নয়ন ও আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবন আজ অতিষ্ঠ। অনেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছেন, এরপরও নিয়ন্ত্রনহীন খরচের লাগাম টানতে পারছেন না। নির্বিকার নিম্ন আয়ের মানুষ, জীবনধারণে ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে আয়ের পুরোটা। চিকিৎসা, শিক্ষাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ে দেখা দিচ্ছে অর্থসংকট, ফুটে উঠেছে অসহায়ত্ব।

বেকার সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন মহামারীর কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নেমে এসেছে অর্থনৈতিক স্থবিরতা। ব্যবসা-বাণিজ্য-কর্ম হারিয়ে অনেকেই আজ নিঃস্ব। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, পেনশনভোগী, নির্দৃষ্ট ও স্বল্প আয়ের মানুষ, যাদের আয়ের টাকার প্রতিটি অংশই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্ল্যান করে মাসে নির্দিষ্ট হারে টাকা জমিয়ে নির্ধারিত কোন সামাজিক পারিবারিক উৎসব বা বাড়তি খরচের ব্যবস্থা করে থাকেন। তাদের জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এককথায় বিভীষিকাময়। সরকারি হিসাবেই প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। মোটা চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম অয়েলও, পেঁয়াজ, ডিম, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, জিরার দাম বেড়েছে বলে টিসিবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ নেই। অনেকেই কোনমতে দুমুঠো খেয়ে জীবন ধারণ করে আছে, সেখানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আঘাত জনজীবন পর্যুদস্ত ও ভয়াবহ রূপ নেবে এটাই স্বাভাবিক। কৃষক, শ্রমিক, মজদুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মেহনতি খেটে-খাওয়া অভাবী মানুষের কথা না হয় বাদ দিলাম, খোদ সরকারি চাকরিজীবীরাও দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রনহীন ঊর্ধ্বগতিতে নির্বাক। সরকার নির্ধারিত ২০টি গ্রেডের মধ্যে ১০-২০তম মোট ১১টি গ্রেডের চাকরিজীবীদের জীবনযাত্রায় তেমন স্বাচ্ছন্দ নেই। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ যোগাতেই যেখানে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়, সেক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চরম হতাশাজনক। জাতির ভবিষ্যৎ তৈরির কারিগর হিসেবে খ্যাত সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সহকারি শিক্ষকগণ ১৩ নং গ্রেডে নিয়োজিত আছেন।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে জাতির একজন শিক্ষক- বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট টিভি, ব্যবহার যোগ্য বাড়ি, সুষম খাদ্য গ্রহণ, চিকিৎসা, যাতায়াত, সন্তানের শিক্ষা, মা-বাবা, ভাই-বোনের ভরণপোষণ, দৈনিক খবরের কাগজসহ সামাজিকতা রক্ষায় ন্যুনতম ব্যয় করার অধিকার রাখেন। একজন শিক্ষকের সর্বসাকুল্যে মাসিক আয় ১৭,৬৫০ টাকা। তবে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকগণ কিছু টাকা বেশি আয় করে থাকেন।

বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে দেশের সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সহকারি শিক্ষকগণ প্রতিনিয়ত আন্দোলন করে যাচ্ছেন, যা লক্ষনীয়। এমতবস্থায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মরার উপর খাঁড়া ঘা স্বরূপ। নিত্যপণ্যের নিয়ন্ত্রনহীন মূল্যবৃদ্ধিতে তারা যদি হতাশায় এতটা উদ্বিগ্ন থাকেন, সেক্ষেত্রে আরও নিচের গ্রেডের সরকারী চাকরিজীবীরা কতটুকু মানবেতর অসহায় জীবন-যাপন করছেন, তা অবশ্যই অনুমেয় (তবে, যারা ঘুষ দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের কাছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক বিষয়)।

বর্তমান পেক্ষাপটে একজন খেটে-খাওয়া সংসারের অসহায় কর্তা ব্যক্তির কাছে ৫৪ টাকা কেজি মোটা চাল কেনার পর ৬০ টাকা কেজি পেঁয়াজ, ৪০ টাকা হালি ডিম, ১২০ টাকা কেজি মসুর ডাল, ১৮০-১৯০ টাকা লিটার সোয়াবিন তেল, ১৭৫ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি, ৬৫০ টাকা দামের গরুর মাংস উচ্চ বিলাসী স্বপ্ন হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে জনজীবনে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার হিসাব মিলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) পণ্য বিক্রির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক গুলোতে ভিড় করছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। জঠরের জ্বালা যে বড় কষ্টের, যতক্ষণ না ওখানে গিয়ে কিছু পড়ছে ততক্ষণ নিস্তার নেই! বাঁচার তাগিদে সামাজিক অবস্থান ভুলে মধ্যবিত্তরা সুযোগ মত ঢুকে পড়ছে অভাবীদের লাইনে। এ এক অসহনীয় যাত্রা, এর পরিত্রান জরুরী।

বছরের কিছু কিছু সময় হঠাৎ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যায়। সবকিছু কেমন জানি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ওঠে। বাজার বিশ্লেষনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে যে সকল নির্ভরযোগ্য যুক্তি খুঁজে পাই তা হলো- পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন বা সরবরাহ বা যোগান কম। অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি। মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিকতর মুনাফা অর্জন। চোরাচালানের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অন্যদেশে পাচার। সরকার কর্তৃক অধিক কর বৃদ্ধি। কালো টাকার দৌরাত্ম্য। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি। ঘুষ-দুর্নীতির কারণে পণ্যের আমদানি ও সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি। উৎপাদিত বা আমদানিকৃত পণ্যের সঠিক সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। পণ্য সরবরাহ ও বন্টনে অব্যবস্থাপনা। বিশ্ব বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি।

যুদ্ধ কারও জন্যই সুফল বয়ে আনে না। যুদ্ধে যেমন প্রাণক্ষয় হয়, তেমনি জীবিতদের জন্যও বয়ে আনে দুর্ভোগ। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়েই। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশের বেশি গমের সরবরাহ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। আর বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি সূর্যমুখী তেল সরবরাহ করে ইউক্রেন। দেশে গত কয়েক মাসে কেজিপ্রতি আটার দাম বেড়েছে ১০ টাকার মতো। বেড়েছে বেকারি পণ্যের দামও। অনেক ইউরোপীয় দেশ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

কিছু কিছু পন্যের মূল্য বৃদ্ধি বর্তমান বিশ্ব অস্থিরতার ফসল, এটা অস্বীকারের কিছু নেই। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের অর্থনৈতিক সার্বিক পরিবেশ আরো নাজুক হতে পারে। সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় সরকারের দূরদর্শিতামূলক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত জরুরী। চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য তৈরি করা। প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানি উন্নতকরণ। পন্য বাজারজাতকরণে সজাগ দৃষ্টি। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সে বিষয়ে অধিকতর সর্তকতা। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ। ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ। আমদানি ও উৎপাদন ব্যয় হ্রাস। পণ্য সংরক্ষণ ও সুষম বন্টন। কর বৃদ্ধি না করা।

সর্বোপরি সরকারের সদিচ্ছা, সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণপূর্বক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।

সংকট তৈরি হয় ধীরে ধীরে। যারা সংকটকে পাশ কাটিয়ে উচ্চবিলাসী কথাবার্তায় মশগুল থাকে, তোষামোদি করে, উচ্চমহলকে ভুল বার্তা দেয়, তাদেরকে পরিহার করে প্রান্তিক জনগণের চাহিদা বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, সংকট অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। চাঁদের আলোকে যেমন লুকিয়ে রাখা যায় না, তেমনি কোন জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বার্তা কাউকে পৌঁছানোর প্রয়োজন হয় না, তা আলোকবর্তিকা হয়ে এমনিতেই সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়বো সমৃদ্ধির বাংলাদেশ।এই হোক আমাদের ব্রত।

email: [email protected]

 

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]