8479

03/29/2024 বাংলা ভাষার রকম ফের

বাংলা ভাষার রকম ফের

জুনায়েদ আলী সাকী

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৪৭

পৃথিবীর অন্যতম বহুল প্রচলিত ভাষা বাংলা। ৩৩ কোটির বেশি মানুষ কথা বলে এই ভাষায়। জনসংখ্যায় ভাষাভাষীর দিক থেকে পৃথিবীরতে বাংলার স্থান সপ্তম। ইংরেজি, চীনা, হিন্দী, স্প্যানিশ, আরবী, রাশিয়ান ভাষার পরই বাংলার স্থান। এত বেশি সংখ্যক মানুষ এই ভাষায় কথা বললেও সবার বাংলা কিন্তু সমান নয়।

স্থানীয়ভাবে মানুষ যে কথ্য ভাষা ব্যবহার করে তাকে বলে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা (Dialect)। অন্যান্য ভাষার মত বাংলারও আছে অনেকগুলো উপভাষা। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৭ মাইল বা প্রায় ১১ কিলোমিটার অন্তর ভাষার পরিবর্তন হয়। তবে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা; যেমন- পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, বন-জঙ্গল থাকলে আঞ্চলিক ভাষায় পার্থক্য বেশি হয়। বাংলার আঞ্চলিক ভাষা প্রধানত ১৩ ধরণের।

১. রাঢ় বাংলা : পুরুলিয়া জেলাকে কেন্দ্র করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম এলাকা এবং ঝাড়খান্ড রাজ্যের পূর্ব অংশে রাঢ় বাংলা প্রচলিত। বাংলার এ আঞ্চলিক ভাষার সাথে মিশ্রিত আছে অনেক হিন্দী ও উড়িষ্যা শব্দ।

২. কাঁথী বাংলা : ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উপকূলীয় পূর্ব মেদিনিপুর জেলা এবং আশেপাশের এলাকায় কাঁথী বাংলার প্রচলন। বাংলার উপভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম জনগোষ্ঠি এই ভাষায় কথা বলে।

৩. কোলকাতা বাংলা : ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা এবং এর দক্ষিণে উপকূল পর্যন্ত যেসব জেলা রয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের স্থানীয় ভাষা এটি।

৪. নদীয়া বাংলা : বাংলা ভাষার মূল প্রমিত রূপ এটি। অর্থাৎ নদীয়া বাংলা হচ্ছে মূল বাংলা। এর থেকে দূরত্ব ভেদে বিবর্তিত হয়েছে বাংলা ভাষা। পশ্চিমবঙ্গে পদ্মা-ভাগিরথী’র বিভাজনস্থল থেকে ভাগিরথী নদীর উচ্চ অববাহিকা এবং বাংলাদেশে প্রবেশস্থল থেকে পদ্মা নদীর দক্ষিণ অংশের বাসিন্দারা কথা বলেন এই ভাষায়। অর্থাৎ ভারতের বৃহত্তর নদীয়া এলাকা এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের ভাষা নদীয়া বাংলা।

৫. মালদা বাংলা : পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর-দক্ষিণ দিনাজপুর এবং এসব এলাকা লাগোয়া বিহার ও ঝাড়খান্ড রাজ্যের পূর্বাংশে এই ভাষার প্রচলন। বাংলার এ উপভাষা ব্যবহারকারীর বেশিরভাগই মুসলিম জনগোষ্ঠি। মালদা বাংলা ব্যবহারকারীরা শেরশাবাদী (ঝযবৎংযধনধফর) হিসেবে পরিচিত হলেও তারা নিজেদেরকে দাবি করেন শায়েখ বা শেখ হিসেবে।

৬. বরেন্দ্র বাংলা : বাংলাদেশে পদ্মা নদীর উত্তরে এবং যমুনা নদীর পশ্চিমে বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলাগুলোতে বাংলাভাষার এই রূপের প্রচলন। অর্থাৎ পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া এবং বৃহত্তর রাজশাহী এলাকার স্থানীয় ভাষা বরেন্দ্র বাংলা।

৭. রংপুর বাংলা : উপভাষাগুলোর মধ্যে ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি রংপুর বাংলার। বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল, ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার পশ্চিম এলাকা, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার অঞ্চল, বিহার রাজ্যের উত্তর-পূর্বাংশ এবং নেপালের দক্ষিণ-পূর্বাংশের স্থানীয় ভাষা এটি। বিহারের সূর্যপুরী, নেপালের রাজবংশী এবং পশ্চিমবঙ্গের কামতাপুরী ভাষার সাথে রংপুর বাংলার অনেক মিল রয়েছে।

৮. সিলেটি বাংলা : বর্তমান বাংলার অন্যতম বিবর্তিত উপভাষা সিলেটি। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ, ভারতের আসাম রাজ্যের বারাক উপত্যকা ও হোজাই জেলা এবং উত্তর ত্রিপুরার স্থানীয় ভাষা সিলেটি। এর পাশাপাশি বহু সিলেটি বংশোদ্ভুত বসবাস করেন ভারতের মেঘালয়, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যে।

৯. ঢাকাইয়া বাংলা : বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর ও ময়নসিংহ অঞ্চল এবং টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলায় বাংলার এই উপভাষা বিস্তৃত।

১০. বরিশাল বাংলা : বাংলাদেশে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার বাসিন্দাদের ভাষা এটি।

১১. যশোরী বাংলা : বাংলাদেশে বৃহত্তর খুলনা ও যশোর অঞ্চলের ৭ জেলায় স্থানীয়ভাবে ব্যবহার হয় যশোরী বাংলা।

১২. চাটগাঁইয়া বাংলা : বাংলা ভাষার আরেক বিবর্তিত উপভাষা চাটগাঁইয়া। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাংলার এই উপভাষা ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় বাংলা শব্দের বিবর্তিত রূপের ব্যবহার আছে। এর পাশাপাশি কক্সবাজার জেলার স্থানীয় বাংলার সাথে অনেক মিল রয়েছে রোহিঙ্গা ভাষার।

১৩. নোয়াখালী বাংলা : বাংলা ভাষা কিছুটা বিবর্তিত হয়েছে এখানে। বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের ৬ জেলার মানুষ কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন নোয়াখালী বাংলা।

ইদানিং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম এবং বেসরকারী বেতার গণমাধ্যমে ব্যবহার হচ্ছে বাংলাভাষার নতুন এক বিবর্তিত রূপ। ইংরেজির সাথে বাংলা শব্দের মিশ্রণ হচ্ছে কোন ধরণের ব্যাকরণ ছাড়াই।

এছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূলীয় দেশ সিয়েরা লিওনে ঘটেছে বাংলার বিস্তৃতি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয়দের সাথে দীর্ঘদিন ধরে কাজের সুবাদে বাংলার বিস্তার ঘটেছে এখানে। ফলে বহুল ব্যবহারের কারণে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয় দেশটি।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]