তিন দশকে মাতৃমৃত্যুর হার অর্ধেকে নেমেছে ঠিকই, কিন্তু গতি এখন প্রায় থেমে গেছে। দেশে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ১৩৬–এ নেমে এলেও লক্ষ্য ৭০–এ পৌঁছানোর পথ এখনও কঠিন। মৃত্যুর বেশির ভাগই ঘটছে প্রসবের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, আর অ্যান্টেনাটাল কেয়ারের ঘাটতি, বাড়িতে প্রসবের প্রবণতা আর বাড়তি ফার্টিলিটি রেট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে— এমনটাই জানিয়েছে ওবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি)।
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) রাজধানীর বিএমএ ভবনে বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সদস্যদের সঙ্গে ওবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) মতবিনিময় সভায় সংগঠনটির পক্ষ থেকে এসব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম, অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান এবং সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ফিরোজা বেগম। বিএইচআরএফ সভাপতি রাশেদ রাব্বী আলোচনায় অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমলেও গত কয়েক বছরে এই অগ্রগতি প্রায় স্থবির অবস্থায় আছে। ১৯৯০ সালে প্রতি লাখে ৫৭৪ জন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতেন। পরের তিন দশকে এটি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে দাঁড়ায় ২৫২, পরে ১২৮, আবার কিছুটা ওঠানামা করে ২৯ কমে বর্তমানে এসে ১৩৬–এ স্থির হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০–এ নামিয়ে আনার কথা, আর সেই পথটাই এখন কঠিন হয়ে উঠছে।
সভায় বক্তারা জানান, মাতৃমৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণের মধ্যে রয়েছে প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ, গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ, বাধাগ্রস্ত প্রসব, সংক্রমণ এবং নানা জটিল রোগ। এর বাইরে রক্তস্বল্পতা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড রোগও মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মাতৃমৃত্যু অনেক বেশি। ২০১৯ সালে শহরে মাতৃমৃত্যু ছিল প্রতি লাখে ১২৩; বর্তমানে তা কমে ৫৬–এ দাঁড়িয়েছে। গ্রামে ১৯১ থেকে কমে ১৫৭–এ এলেও ব্যবধান এখনও বিশাল।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়—মাতৃমৃত্যুর ৫৪ শতাংশই ঘটছে বাড়িতে, আর এসব মৃত্যু প্রায় সবই প্রসবের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। জরিপে দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ মা নিয়ম অনুযায়ী অন্তত চারবার অ্যান্টেনাটাল কেয়ার নেন না, যা দ্রুত জটিলতা চিহ্নিত করার সুযোগ কমিয়ে দেয়। প্রসবের সময় হাসপাতাল এড়িয়ে যাওয়া, অদক্ষ সেবাদাতার ওপর নির্ভরতা এবং পরিবারগুলোতে প্রসব নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভুল ধারণা ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে।
এসময় অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, “মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ। এই গতিতে চললে এসডিজি অর্জন সম্ভব হবে না।”
তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রেক্ষাপটে জানান—কমপক্ষে আটবার প্রসবপূর্ব সেবা নেওয়ার কথা থাকলেও দেশে সে হার ‘খুবই সীমিত’। তিনি মাতৃমৃত্যু কমানোর জন্য একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতির কথা জানান, যা ইতোমধ্যেই প্রকল্প এলাকায় সফল হয়েছে। সহজলভ্য পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ত্রিকোণ আকৃতির বিশেষ থলি তৈরি করা হয়, যা প্রসবের সময় রক্তস্রাব পরিমাপ করতে সাহায্য করে। পাঁচ টাকার এই থলি নার্স বা মিডওয়াইফরা নিজেরাই তৈরি করতে পারেন। সময়মতো রক্তক্ষরণ শনাক্ত করে চিকিৎসা দিলে অনেক প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।
সভায় জানানো হয়, ডিজিএইচএস, ডিজিএফপি, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড গাইন্যাকোলজি (ফিগো) এবং ওজিএসবি যৌথভাবে ২০২৩ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ফরিদপুরের চারটি সরকারি হাসপাতাল এবং ঢাকার দুটি অলাভজনক হাসপাতালে এই প্রকল্প চালিয়েছে। এতে মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধে রক্তক্ষরণ পরিমাপের পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, “প্রসবের পর ২৪ ঘণ্টাই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়েই ৫৫ শতাংশ মা মারা যান। তারপরও অনেক মা ৮ ঘণ্টাও হাসপাতালে থাকতে চান না।”
তিনি জানান, পরিবার ও সামাজিক মানসিকতা বদলানো না গেলে মাতৃস্বাস্থ্য সেবায় অগ্রগতি ধরে রাখা কঠিন হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো কেবল চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন দিয়ে সম্ভব নয়— প্রসবের সময় নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষমতা বাড়ানো, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিবার পর্যায়ে সচেতনতা এবং নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।