ইসলামের ইতিহাসে মক্কা বিজয় এক অনন্য গৌরবময় অধ্যায়। হিজরি ৮ম সনের রমজান মাসে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী কোনো যুদ্ধ ছাড়াই মক্কা জয় করেন। এই বিজয় ছিল মিথ্যার ওপর সত্যের চূড়ান্ত বিজয়। আর এই ঐতিহাসিক বিজয়ের অব্যবহিত পরেই ঘটে একটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনা, যা মক্কা বিজয়ের প্রকৃত মাহাত্ম্যকে আরও গভীরভাবে তুলে ধরে।
প্রথম আজান: ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এক মহান মুহূর্ত
বিজয়ের পর যখন প্রথম সালাতের সময় আসে, নবী কারিম (স.) তাঁর প্রিয় সাহাবি ও বিশ্বস্ত মুয়াজ্জিন হজরত বিলাল (রা.)-কে নির্দেশ দেন কাবার ছাদে উঠে আজান দিতে। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যে পবিত্র কাবা একসময় মুশরিকদের পূজা-অর্চনার কেন্দ্র ছিল, আজ তারই ছাদে উচ্চারিত হতে লাগল তাওহিদের (একত্ববাদের) মহান আহ্বান—আল্লাহু আকবর; এক নতুন যুগের মহান মুহূর্ত।
কোরাইশ নেতাদের মানসিক সংঘাত ও সংলাপ
আজানের সময় কাবার পাশেই অবস্থান করছিলেন মক্কার বিশিষ্ট নেতারা—আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আত্তাব ইবনে আসিদ ও হারিস ইবনে হিশাম। এরা একসময় ইসলামের কট্টর শত্রু ছিলেন। আজান শুনে তাদের অন্তরে সৃষ্টি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও মানসিক দ্বন্দ্ব। আত্তাব বললেন, ‘আল্লাহ উসাইদ (আমার পিতা)-কে এই দিন দেখার আগেই মৃত্যুবরণ করিয়েছেন; এটা তাঁর জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ, তাঁকে এই অপছন্দনীয় আওয়াজ (আজান) শুনতে হয়নি।’
হারিস গভীর চিন্তায় পড়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি যদি নিশ্চিতভাবে জেনে যাই যে, এই ধর্মই সত্য, তবে অবশ্যই আমি তা গ্রহণ করব।’
আর আবু সুফিয়ান, যিনি তখন ইতোমধ্যেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, কৌশলে বললেন- ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না। কারণ, যদি কিছু বলি, এই কাবার পাথরগুলোও হয়ত তা নবীজির (স.) কাছে পৌঁছে দেবে!’
নবীজির (স.) অলৌকিক জ্ঞান ও কোরাইশ নেতাদের বিস্ময়
কিছুক্ষণ পরই রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁদের কাছে এসে বললেন- لَقَدْ عُلِمْتُ الَّذِيْ قُلْتُمْ অর্থাৎ, ‘তোমরা যা কিছু বলেছ, আমি তা জেনে গেছি।’ এরপর তিনি তাঁদের আলোচনার প্রতিটি শব্দ হুবহু পুনরাবৃত্তি করে শোনান। হারিস ও আত্তাব হতবাক হয়ে গেলেন এবং বললেন- ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুল (স.)। আল্লাহর কসম! আমাদের কথাগুলো কেউ শোনার কথা নয়; কোন মানুষ বা কোনো শ্রোতা। তবুও আপনি তা জানলেন কীভাবে? এটা আপনার নবুয়তের সুস্পষ্ট প্রমাণ!’
ঘটনাটির তাৎপর্য: হৃদয়ের রাজ্য বিজয়
এই হৃদয়স্পর্শী ও অলৌকিক ঘটনা মক্কা বিজয়ের প্রকৃত রূপ উন্মোচন করে। যারা এক সময় ইসলামের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়েছিলেন, তাঁরাই এখন সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।
এই ঘটনা আমাদের কী শেখায়?
নবুয়তের প্রমাণ: আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুলকে গায়েবের জ্ঞান দিয়েও সহযোগিতা করেছেন।
সত্যের বিজয়: যারা এক সময় ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিলেন, তাঁরাই সত্যের সামনে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।
হেদায়াতের অলৌকিকতা: আল্লাহ যার অন্তরে হেদায়াত দেন, সত্য তার হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়।
আজানের শক্তি: আজান কেবল নামাজের আহ্বান নয়, বরং মানুষের হৃদয় পরিবর্তনের এক অলৌকিক মাধ্যম।
এক কালজয়ী শিক্ষা
মক্কা বিজয়ের পরে কাবার ছাদে হজরত বিলাল (রা.)-এর ঐতিহাসিক আজান এবং কোরাইশ নেতাদের হৃদয়ের পরিবর্তন আজও ইসলামের ইতিহাসে এক কালজয়ী শিক্ষা হিসেবে চিরজাগ্রত। এই ঘটনা আমাদের শেখায়- সত্যের আলো একদিন ঠিকই সমস্ত অন্ধকারকে পরাজিত করে। এটি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের জন্যও এক অনন্ত শিক্ষা যে, অহংকার ও একগুঁয়েমি সত্যকে আড়াল করে রাখে, আর নম্রতা ও সত্যসন্ধানী মন আল্লাহর পথের দ্বার পরিষ্কার করে দেয়।
(আর-রাহিকুল মাখতুম; ইবনে হিশাম, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)