কেরালার এক শান্ত চার্চে দেখা হয় দুই তরুণ-তরুণীর। একদিকে উত্তর ভারতের রুক্ষ অথচ প্রাণোচ্ছল যুবক পরম, অন্যদিকে দক্ষিণের স্নিগ্ধ অথচ দৃঢ়চেতা সুন্দরী। এক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়, তারপরই শুরু হয়ে যায় প্রেমকাহিনির যাত্রা। ট্রেলারের এই দৃশ্যই যেন দর্শককে টেনে নিয়ে গেছে পুরোনো দিনের বলিউডে। এই সুন্দরীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাহ্নবী কাপুর। তার ভেতরের গল্প কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। জাহ্নবী এখন আর কেবল ‘শ্রীদেবীর কন্যা’ নন। তিনি বলিউডে নিজের পরিচয় তৈরি করছেন ধীরে ধীরে, প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ছবির মাধ্যমে। গ্ল্যামার আর আত্মবিশ্বাসের পাশাপাশি তিনি হয়ে উঠছেন এক শিল্পী। সেই কারণে বলিউডের অদৃশ্য প্রতিযোগিতার ময়দানে তিনি আজ আলাদা করে নজর কাড়ছেন। শিশু বয়সেই জাহ্নবীর জীবন ছিল ভিন্ন। চারপাশে ক্যামেরার ঝলকানি, আলো-আঁধারির মধ্যে বড় হয়ে ওঠা। তাঁর মা শ্রীদেবী তখন বলিউডের রানী। সেই আলো-আভা জাহ্নবীর জন্য একদিকে আশীর্বাদ, অন্যদিকে অভিশাপ। ছোটবেলা থেকেই তাঁকে বলা হতো ‘তুমি শ্রীদেবীর মেয়ে।’ তিনি বারবার বলেছেন, কৈশোরে যখন মানুষ নিজেকে খুঁজে পেতে চায়, তখন তাঁর পরিচয়ের সামনে সবসময় লেগে থাকত মায়ের নাম।
২০১৮ সালে ‘ধড়ক’-এর মাধ্যমে বলিউডে অভিষেক হয় জাহ্নবীর। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল না হলেও নজর কাড়েন জাহ্নবী। তখনই শুরু হয় তাঁর সঙ্গে মা শ্রীদেবীর তুলনা। ‘শ্রীদেবীর মতো নাচতে পারে?’, ‘ওর অভিনয়ে কি সেই মাধুর্য আছে?’ জাহ্নবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি চাইতাম মা যেন আমার শুটিং সেটে না আসেন। কারণ আমি চাইতাম মানুষ বলুক, আমি আমার পরিশ্রমে দাঁড়িয়েছি।’ আজ তিনি বুঝেছেন, সেটিই ছিল তাঁর বোকামি। কারণ শ্রীদেবীর ছায়া থেকে কখনোই আলাদা হওয়া সম্ভব নয়; বরং সেই ছায়াটাই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি।
প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের পর সহজ হতো জাহ্নবীর জন্য শুধু গ্ল্যামার গার্ল হিসেবে থেকে যাওয়া। তিনি বেছে নিলেন কঠিন পথ। ‘গুঞ্জন সাক্সেনা: দ্য কারগিল গার্ল’ সিনেমায় তিনি নিজেকে ভেঙে একজন বাস্তব চরিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তুললেন। এরপর ‘গুডলাক জেরি’, ‘মিলি’, ‘বাওয়াল’ প্রতিটি ছবিতেই তিনি ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। সমালোচকরা বলছেন, জাহ্নবীর মধ্যে আবেগ আছে, চেষ্টা আছে, যা হয়তো সবসময় নিখুঁত নয়, কিন্তু সেই অসম্পূর্ণতাতেই তাঁর অভিনয় আলাদা হয়ে দাঁড়ায়। সেটিই দর্শকের কাছে তাঁকে আপন করে দেয়। অভিনয় জীবনের পাশাপাশি জাহ্নবীর আরেকটি পরিচয় আছে। সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশন। ইনস্টাগ্রামে তাঁর কোটি কোটি অনুরাগী। মাঝেমধ্যে মজার, দুষ্টুমিভরা বা আবেদনময়ী ছবি পোস্ট করেন। তাতেই মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ তাঁকে শুধুই ‘গ্ল্যামার কুইন’ বলতে চান। কিন্তু জাহ্নবী নিজেই জানেন, সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে একজন অভিনেত্রী হিসেবে। সে কারণে ফটোশুটের জৌলুসে যেমন আছেন, তেমনি আছেন সেটে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমও।
২০১৮ সালে শ্রীদেবীর আকস্মিক মৃত্যু যেন ভেঙে দিয়েছিল জাহ্নবীকে। তখনই মুক্তি পায় ‘ধড়ক’। জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের সময়েই হারান সবচেয়ে বড় শক্তিকে। জাহ্নবী বলেন, ‘আজ আমার সবচেয়ে বড় অনুশোচনা এই যে, মাকে আমার কাজ দেখাতে পারিনি।’ তবুও মায়ের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে তিনি লড়াই করে যাচ্ছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘মা বলতেন, শুরুটা দিয়ে বিচার করা হয় না। শেষ ছবিটাই মানুষ মনে রাখে।’ এই কথাই আজ তাঁর জীবনের মন্ত্র। বলিউডের বাইরে এখন দক্ষিণী ছবিতেও কাজ করেছেন জাহ্নবী। এতে বোঝা যায়, তিনি নিজেকে কেবল এক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না; বরং চান, সমগ্র ভারত তাঁকে চিনুক একজন শিল্পী হিসেবে। এবার আসা যাক তাঁর নতুন ছবি পরম সুন্দরী প্রসঙ্গে। এই ছবিতে জাহ্নবীর সহশিল্পী সিদ্ধার্থ মালহোত্রা। ছবির গল্পে উত্তর ভারতের ছেলে পরম বেড়াতে যায় কেরালায়। সেখানে এক বাড়িতে উঠেই পরিচয় হয় স্থানীয় মেয়ে সুন্দরীর সঙ্গে। শুরু হয় দুষ্টুমি, খুনসুটি, তারপর প্রেম। দুই সংস্কৃতি, দুই প্রান্তের মানুষ। তাদের সম্পর্ক কি টিকে থাকবে? ট্রেলারের শুরুতেই দেখা যায়, চার্চে তাদের প্রথম দেখা। তারপর নানান উষ্ণ মুহূর্তে ফুটে উঠেছে প্রেমকাহিনি। শুধু রোমান্স নয়, ছবিতে আছে মান-অভিমান, দূরত্ব আর টানাপোড়েন। সব মিলিয়ে দর্শক পাবেন নতুন ধাঁচের প্রেমের গল্প।
জাহ্নবীর সাত বছরের অভিনয় জীবনে ছবির তালিকা হয়তো ছোট, কিন্তু জনপ্রিয়তায় তিনি ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। সামনে তাঁর লক্ষ্য আরও বড়। তিনি চান, একদিন যখন মানুষ তাঁর নাম শুনবে, তখন বলবে ‘সে শুধু শ্রীদেবীর মেয়ে নয়, সে জাহ্নবী কাপুর।’ জাহ্নবীর স্বপ্ন এখন শুধু নায়িকা হয়ে নয়; বরং তিনি চান একজন সিরিয়াস অভিনেত্রী হতে। তাইতো জাহ্নবী জানান, তিনি এগিয়ে যাবেন, যতদিন না তাঁর ভক্ত, দর্শক এবং সমালোচকরা একসঙ্গে বলে ওঠেন ‘সে শুধু পরম সুন্দরী নয়, সে জাহ্নবী কাপুর।’