করোনাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অনলাইন ব্যবসা। বিশেষভাবে নারীদের একটি বড় অংশ পড়ালেখা, ঘরের কাজ এবং চাকরির পাশাপাশি এই সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর্থিক সচ্ছলতা কিংবা নিজেকে পরিবারের একজন আয়ের উৎস হিসেবে দাঁড় করাতে নারীরা এই খাত পছন্দ করে।
অন্যদিকে স্বল্প বিনিয়োগ, প্রচুর শ্রোতা, ঘর ভিত্তিক এবং একটি ডিভাইস নির্ভর কাজ হওয়ায় অসংখ্য নারীর আয়ের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে এই অনলাইন প্লাটফর্ম। স্বল্প বিনিয়োগে উঠে আসা এই আয় ছাত্র-ছাত্রী এবং গৃহিণীদের জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে আনে, যার কারণে এই খাতে কাজ করার আগ্রহ বেশি দেখা যায়। এটি মূলত ডিভাইসকেন্দ্রিক এবং দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করার একটি ক্ষেত্র যা স্বাস্থ্যের জন্য কিছুটা বৈরী বলা যায়।
এছাড়াও শুধু অনলাইনে ব্যবসার কাজেই ডিভাইস ব্যবহার হয় তা নয়, নারী বা পুরুষ সবাই দিনের একটি অংশ সামাজিক মাধ্যমে থাকার কারণে ডিভাইস ব্যবহার করে থাকেন। এই ডিভাইস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম ডেকে আনে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি। স্বাস্থ্য ঝুঁকির ভেতর রয়েছে শারীরিক এবং মানসিক বিষয়গুলো।
পূর্বে যখন ডিভাইসকেন্দ্রিক কাজ ছিল না মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করতেন কায়িক শ্রমকেন্দ্রিক কাজে বা শারীরিক কার্যকলাপে। বর্তমান সময়ে ঘরে বসে আয়ের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে এই ডিভাইসকেন্দ্রিক কাজ যা কমিয়ে দিচ্ছে শারীরিক কার্যকলাপের হার।
এছাড়াও আগে দেখা যেত কেবল বই পড়ার কাজেই দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা হতো, অন্যদিকে বর্তমানে অনলাইন আয়ের কাজ ছাড়াও বিনোদনের একমাত্র বাহন যেন এই ডিভাইস নিয়ে বসে বা শুয়ে থাকা।
দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, লম্বা সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর নয়, যার কারণে শারীরিক নড়াচড়া, পরিশ্রম কম হওয়ার ফলে মেটাবোলিজম ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং ভুল ভঙ্গিতে বসা হতে পারে শারীরিক বিভিন্ন অঙ্গের ব্যথার কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শারীরিক কার্যকলাপ হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অবদান রাখে, বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের মতো ব্যাপারগুলো হ্রাস করে এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। কারণ, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তায় ক্যালোরি বার্ন কম হয়ে থাকে, দ্রুত ওজন বৃদ্ধি পায়, পেশী শক্তি কম হয়, হাড় দুর্বল করে, চর্বি এবং শর্করা ভাঙতে সমস্যা দেখা দেয়, রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এবং বিপাকে সমস্যা দেখা দেয় যার ফলে বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, শতকরা ৩১ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং শতকরা ৮০ জন কিশোর-কিশোরী শারীরিক কার্যাবলীর সুপারিশকৃত মাত্রা পূরণ করে না, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
২০২০ থেকে ২০৩০ এর ভেতর শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা কমানো না গেলে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে বলে ধারণা করা হয়।
অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার বয়ে আনে টেকনোস্ট্রেসের মতো সমস্যা যার ফলে ভুগতে হয় মানসিক সমস্যায়। অনলাইন কাজ করে থাকেন প্রায় কম বয়সী উদ্যোক্তারাই এমন সমস্যায় ভোগেন। টেকনোস্ট্রেসের ফলে দেখা দেয় ঘুমের সমস্যা, মাথাব্যথা, বিষণ্নতা এছাড়াও মেজাজ বা রাগ নিয়ন্ত্রণে অপারগতা। এছাড়াও দেখা যায় অনলাইন কাজগুলো বেশিরভাগ করা হয় সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত, যখন আসলে মানব শরীরের বিশ্রামের সময় এবং যার ফলে ভুগতে হয় ঘুমের সমস্যায়। এর প্রভাব পড়ে পরের দিনের কাজের ওপর এবং দক্ষতা কমার আশঙ্কা দেখা দেয়।
চীনের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত ৫৪০ জন স্নাতক শিক্ষার্থীর নমুনা সংগ্রহ করে দেখা যায় যে, বাধ্যতামূলক স্মার্টফোন ব্যবহার পরোক্ষভাবে টেকনোস্ট্রেসের প্রভাবের কারণে ঘুম এবং একাডেমিক সমস্যা দেখা দেয়।
এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসে, বিশেষ করে নারী এবং তরুণদের মাঝে উদ্বেগ ও বিষণ্নতাজনিত ব্যাধি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মূলে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত উপস্থিতি, স্মার্টফোন আসক্তি এবং বিভিন্ন সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন। এছাড়াও অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহার কমাচ্ছে পারিবারিক সান্নিধ্য এবং আবহ। এই আইসলেশোনের ফলে ভুগছে তরুণেরা মানসিক স্বাস্থ্যের মতো সমস্যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে এই প্লাটফর্মটি আয়ের উৎস হওয়ায় নারী, তরুণরা অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছে এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। তাই এই ব্যাপারে কিছু নিয়ম নীতি যেমন, নিয়মিত বিরতি, হালকা ব্যায়াম, চোখের জন্য সঠিক আলো, সঠিক বসার নিয়ম, পর্যাপ্ত এবং সময়মতো ঘুম এসব ব্যাপারগুলো নিয়মমাফিক করলে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমে আয়ের উৎসকে করতে পারে আরও দীর্ঘস্থায়ী।
ফারহানা ইয়াসমিন : প্রভাষক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এসএন /সিীমা