আওয়ামী লীগ সরকার টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয় ব্যাংক খাতে। এতে এই খাতের ওপর জনসাধারণের আস্থা অনেকটা কমে যায়। তারা তাদের নগদ অর্থ অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকে রাখতে শঙ্কা বোধ করতেন। তবে গত বছরের আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এর ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে। সাধারণ মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকা আবার ব্যাংকমুখী হচ্ছে, যা আর্থিক খাতের জন্য স্বস্তিদায়ক ইঙ্গিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ মার্চের তুলনায় কমেছে প্রায় ১৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর আগে মার্চে হঠাৎ করে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, যা মূলত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট ও দুর্নীতির আশঙ্কায় ছিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়িতে রাখতে শুরু করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চে যেখানে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি ৬ লাখ টাকা, সেখানে এপ্রিল মাসে তা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এক মাসে প্রায় ১৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যাংকে ফিরে এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের হাতে নগদ অর্থ কমে যাওয়ার অর্থ হলো মানুষ আবার ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের তারল্য বাড়বে, যা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতেও টাকার প্রবাহ বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে বাজারে ছাপানো টাকার পরিমাণ বা রিজার্ভ মানি কমেছে ২২ হাজার ৮৮ কোটি ১ লাখ টাকা। মার্চে রিজার্ভ মানি ছিল ৪ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ কোটি ৬ লাখ, যা এপ্রিল মাসে কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৪৫ কোটি ৫ লাখ টাকায়।
একই সময় বাজারে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণও কমেছে। মার্চে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৬০ কোটি ৮ লাখ টাকা, যা এপ্রিল মাসে কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ২ হাজার ৬৮৪ কোটি ২ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এক মাসে কমেছে ১৮ হাজার ৪৭৬ কোটি ৬ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারাবাহিক তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার প্রবণতা ছিল নিম্নমুখী। ২০২৩ সালের আগস্টে এই পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি ৪ লাখ টাকা, যা সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। সেপ্টেম্বরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪ লাখ, অক্টোবরে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি ৭ লাখ, নভেম্বরে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৬ কোটি ৭ লাখ, ডিসেম্বরে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭১ কোটি ৫ লাখ, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৩০ কোটি ৯ লাখ এবং ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৬ লাখ টাকা।
এর বিপরীতে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এরপর নভেম্বরে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি, ডিসেম্বরে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি, মার্চে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি, এপ্রিল ও মে মাসে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি এবং জুনে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকায়। জুলাইয়ে হয় ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৩০ কোটি এবং আগস্টে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি ৪ লাখ টাকায় পৌঁছায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখতেন। পাশাপাশি কিছু ব্যাংক নিয়ে অনাস্থার কারণে অর্থ গচ্ছিত রাখার নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে অনেকেই বাড়িকে বেছে নিয়েছিলেন। তবে এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ফেরায় মানুষ আবার ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন।
এসএন /সীমা