জামালপুরের মেলান্দহে মা-বাবাহারা অসহায় শুভা আক্তারকে (১৯) রাজকীয় আয়োজন করে বিয়ে দিয়েছেন মানবতার ফেরিওয়ালা খ্যাত মামুন বিশ্বাস। শুক্রবার (১৩ জুন) বিকেলে উপজেলার নাংলা ইউনিয়নের ভাটিপাড়ার মৃত আব্দুল খালেকের ছেলে সোনাহার মিয়ার (২১) সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। শুভা আক্তার একই ইউনিয়নের হরিপুর ভাটিপাড়া এলাকার মৃত খোকা শেখ ও মৃত রাশেদা দম্পতির একমাত্র মেয়ে। তার বিয়েতে খরচ করা হয় এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।
বিয়ে উপলক্ষ্যে শুভা আক্তারকে বেশ জাঁকজমকভাবে পার্লারে নিয়ে সাজানো হয়। বিয়েতে সবজি, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস ও দই দিয়ে দুই শতাাধিক মানুষকে আপ্যায়ন করা হয়। শুভা আক্তারের জন্য কেনা হয় বিয়ের শাড়ি, হলুদের কাপড়, জুতা ও কসমেটিক্সসহ বিয়ের বিভিন্ন ব্যবাহারের সামগ্রী। সেই সাথে একটি আলমারি, সুকেস, ড্রেসিং টেবিল, আলনা, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস রাখার একটি বড় বাক্স ও একটি নতুন সংসার বাঁধতে যা যা প্রয়োজন সবই কিনে দেন মামুন বিশ্বাস ও তার সহযোগীরা। বিয়ের দাওয়াতে অংশগ্রহণ করেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ।
এর আগে বৃহস্পতিবার শুভা আক্তারের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠিত হয়। অসহায় শুভা আক্তারের এমন আনুষ্ঠানিক বিয়ে দেখতে কয়েক এলাকার মানুষ ভিড় জমান হরিপুর ভাটিপাড়া এলাকায়। শুভা আক্তার ও সোনাহার মিয়ার ব্যতিক্রমী এই বিয়ে এলাকা জুড়ে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুভা আক্তারের জন্মের ৫দিন পর মা মারা যান। কিছুদিন পর শুভার বাবা বিয়ে করেন। তিন মাস পর শুভার বাবাও মারা যান। তার বাবা মারা যাওয়ার পর সৎ মা শুভাকে ছেড়ে চলে যান। শুভা আক্তারের ঠাঁই হয় দরিদ্র দাদা-দাদির কাছে। এদিকে বাবা মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর তার দাদা-দাদিও মারা যান। প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ করে দিন পার করে শুভা আক্তার। শুভা আক্তারের বিয়ের বয়স হওয়ায় চিন্তায় পড়েন তার প্রতিবেশীরা। শুভার এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হলেও সেটি টাকার অভাবে ভেঙে যায়। তার বিয়ের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেশী জাহানারা বেগম নামে এক নারী পাশ্ববর্তী চাড়াইলদার এলাকার জাকিরুল ইসলামের সাথে কথা বলেন। স্বেচ্ছাসেবক জাকিরুল ইসলাম সিরাজগঞ্জের মানবতার ফেরিওয়ালা খ্যাত মামুন বিশ্বাসের সাথে কথা বললে তিনি শুভার জন্য পাত্র দেখতে বলেন। এদিকে জাহানারা বেগম শুভা আক্তারের জন্য হরিপুর উত্তরপাড়ার মৃত আব্দুল খালেকের ছেলে মুদি দোকানদার সোনাহারের সাথে বিয়ে ঠিক করেন। দুই বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সোনাহার সবার ছোট।
বিয়ের জন্য শুক্রবার হরিপুর ভাটিপাড়া এলাকার স্থানীয় লালমিয়ার বাড়িতে সাজানো হয় ডেকোরেশনের সামিয়ানা, চেয়ার, টেবিল ও বরের আসন। পাশেই চলতে থাকে মেহমানদের জন্য খাবারের আয়োজন। শুক্রবার জুমার নামাজের পর মোটরসাইকেলে বরবেশে উপস্থিত হন সোনাহার মিয়া। আংটি দিয়ে নামানো হয় বর সোনাহার মিয়াকে। অন্যদিকে পাত্রী শুভাকে নিয়ে প্রতিবেশীদের কণ্ঠে গীতের সুর সব মিলিয়ে এক রাজকীয় বিয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরে মামুন বিশ্বাস ও জাকিরুল ইসলামসহ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থেকে শুক্রবার সন্ধ্যায় এক লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ের জিনিসপত্র, নগদ অর্থসহ শুভাকে সোনাহার মিয়ার হাতে তুলে দেন।
নাংলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন কিসমত পাশা জানান, একটা অসহায় এতিম পরিবারের ভেতরে বিবাহবন্ধন করে তাদের পরিবার সচ্ছল করার জন্য এত বড় একটা উদ্যোগ ও অনুষ্ঠান আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। কয়েক বছর যাবৎ উনারা (মামুন বিশ্বাস) বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা যেন ভবিষ্যতে এ রকম আরও ভালো কাজ করে যেতে পারেন ও তাদের সফলতা কামনা করছি।
এমন রাজকীয় বিয়ে হওয়ায় আনন্দিত হয়ে শুভা আক্তার বলেন, আমি কোনো দিন চিন্তাও করি নাই এত বড় আয়োজনে আমার বিয়ে হবে। যারা বিয়ের জন্য কষ্ট করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
সোনাহার মিয়া বলেন, এতিম বলে কোনো কথা না, মেয়েটা যদি ভালো হয় তাহলেই সব ভালো। দাম্পত্য জীবনে সকলের নিকট দোয়া প্রত্যাশা করেন তিনি।
জাহানারা বেগম বলেন, শুভার জন্মের পরই তার মা মারা যান। তার তিন মাস পরেই তার বাবাও মারা যায়। শুভার বয়স হওয়ায় বিয়ের জন্য ভাতিজা জাকিরুলকে জানাই। পরে জাকিরুল মামুন বিশ্বাসকে জানালে শুভার বিয়ের আয়োজন করে। আজকে শুভার বিয়ের হওয়ায় আমরা খুব খুশি।
স্বেচ্ছাসেবক জাকিরুল ইসলাম বলেন, শুরুতে হরিপুরের জাহানারা চাচির মাধ্যমে শুভার বিষয়টি জানতে পেরে মামুন বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করি। মামুন বিশ্বাস ও স্থানীয়দের প্রতি কৃতজ্ঞাতা জানাই। সেই সাথে মামুন বিশ্বাস যেমন সিরাজগঞ্জ থেকে জামালপুরে এসে বিয়ের আয়োজন করেছে। প্রতিটি এলাকায় যেন একটি করে মামুন বিশ্বাস তৈরি হয়, যাতে অন্য এলাকা থেকে মামুন বিশ্বাসকে এনে বিয়ে না দিতে হয়।
মামুন বিশ্বাস বলেন, এর আগেও শুভার বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু টাকার অভাবে ভেঙে যায়। পরে শুভার বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করি। ফেসবুকের পোস্ট দেখে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেক মানুষ সর্বমোট এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়ে শুভার বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। স্থানীয় এলাকাবাসী অনেক সহায়তা করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুভার মতো যে সব বোন আছে, যাদের অর্থের অভাবে বিয়ে হচ্ছে না আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।