369

05/07/2024 সাংবাদিকদের ছবি তোলা নিয়ে বিতর্ক: মোহসিন কবির

সাংবাদিকদের ছবি তোলা নিয়ে বিতর্ক: মোহসিন কবির

মোহসিন কবির

১৩ এপ্রিল ২০২০ ১৭:০৭

দেশে কুপিয়ে হত্যার কত ঘটনাইতো ঘটে কিন্তু বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের মতো কি সেসব ঘটনা আপনার মনকে নাড়া দেয়? ধর্ষণের পর হত্যা প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটছে, কিন্তু দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার মতো ক'টি ঘটনায় গোটা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে? বোমা হামলায় আহত রক্তাক্ত সিরিয়ান শিশুদের ছবি দেখে পাষাণ হৃদয়ও হুহু করে কেঁদে ওঠে, ক্ষোভ আর ঘৃণা জন্ম নেয় এসব নির্মমতার কারিগরদের প্রতি। আবার একটি সুন্দর দৃশ্য আপনার মনকে করে শিহরিত, রোমাঞ্চিত, আন্দোলিত। আপনার এই ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, শিহরিত, রোমাঞ্চিত হওয়ার পেছনে যার ভূমিকা তিনি হলেন ফটোগ্রাফার। একটি ঘটনার ছবি দেখে আপনার মনে যদি ১০০ ভাগ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে; তবে ওই একই ধরনের ঘটনা হয়তো আপনার মাঝে সর্বোচ্চ ৫-১০ ভাগ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে যদি ছবি না থাকে।

বিশ্বজিতকে মারার কিংবা রাসায়নিক বোমায় রক্তাক্ত সিরিয়ান শিশু বা এ ধরনের পরিস্থিতির ছবির বদলে যদি শুধুমাত্র সেখানকার ফটোগ্রাফারদের ছবি তোলার ভঙ্গি কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে প্রকাশ করে দিতো তাহলে আপনার প্রতিক্রিয়া হয়ে যেতো উল্টো। আপনার প্রতিক্রিয়া হতো- "সাংবাদিকরা কত্ত খারাপ! শিশুটি মারা যেতে বসেছে আর ওরা ছবি তুলছে।" কিংবা "বিশ্বজিতকে এভাবে মারছে, আবাল সাংবাদিকগুলো ছবি না তুলে ছেলেটাকে বাচাতে পারতো।" এমন হাজারো উক্তি। অথচ, ভিন্নভাবে একটু ভাবুন- কতটা ঝুঁকি নিয়ে হামলাকারীর ছবি তুলছে সে! অপরাধীদের ছবি তুলতে গিয়ে সাংবাদিকের প্রাণ দেয়ার অসংখ্য নজির আছে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে ছবিটি তুলেছে। কারণ, এই একটি ছবি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি করবে। প্রশাসন বাধ্য হবে বিচার নিশ্চিত করতে। নির্যাতনকারী সমাজে ধিকৃত হবে। এর প্রভাব ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বব্যাপী।

মাঠে কাজ করতে গিয়ে শত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সাংবাদিকতা সম্পর্কে আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে অনেক ভুল/অমূলক ধারণা রয়েছে। কেউ ভাবেন, সাংবাদিকরা পুলিশের মতো। যে কাউকে চাইলেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন কিন্তু করেন না। কেউ ভাবে, সাংবাদিকতা মানে সারাক্ষণ মানুষের বিপদে আপদে ভলান্টিয়ার সার্ভিস দেয়া। আপনার এসব ধারণা হয়তো আংশিক ঠিক আছে। কিন্তু সাংবাদিকরা এসব সেবা বা সার্ভিস যে তার কাজটার মাধ্যমেই দিয়ে থাকেন সেটি অনেকের বোধগম্য হয়না। একটি ছবি কিংবা একটি প্রতিবেদন শুধুমাত্র ওই ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করেনা। এটি আরো দশটি, একশোটি কিংবা হাজারটি ঘটনায় প্রভাব ফেলে। প্রশ্ন তুলতে পারেন, কই পরিস্থিতিরতো কোন উন্নতিতো দেখছি না? কিন্তু সে দায় সাংবাদিকের না। যাইহোক, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। প্রাসঙ্গিক কথায় আসা যাক।

বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বর্তমান করোনা মহামারি পরিস্থিতি বিগত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সবচে ভয়াবহ। ভয়াবহতা এমন যে, বিশ্বব্যাপী মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোকে এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় নিকট শতাব্দীগুলোতে পড়তে হয়নি। ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট বিবেচনায় আমাদের দেশে মসজিদগুলোকে পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা না করে জুমায় ১০ জন এবং অন্য নামাযে ৫ জনের বেশি মুসল্লী না থাকার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের মতো বিশাল মসজিদে যেখানে একসাথে লাখো মুসল্লী নামায আদায় করেন; সেখানে গত জুমায় মাত্র ১০ জনকে নিয়ে নামায পড়েছেন যা ইতিহাসে নজিরবিহীন।

১০ জনে নামায পড়ার সেই দৃশ্য সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধারণ করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই বেঁধেছে। এর কারণ হলো, ছবিতে দেখা গেছে মুসল্লির চেয়ে সাংবাদিক বেশি এবং সেই ছবি প্রকাশিত হওয়া। দেখুন, যারা আল্লাহ প্রেমিক, ইসলামকে যারা ভালোবাসেন- তাদেরকে এই পরিস্থিতি বেদনাহত করছে। লাখো মুসল্লীর বিপরীতে মাত্র ১০ জন নিয়ে নামায পড়ার দৃশ্যটি ইতিহাসে বিরল! সেই বিরল, বেদনাদায়ক দৃশ্যটি ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং আমাদের জন্য শিক্ষা। তাই এটির সংবাদমূল্য অপরিসীম। কিন্তু সাংবাদিকের ছবি তোলা কারো মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে উল্টো ফটোগ্রাফারের প্রতি।

ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে সেটির দিকে না তাকিয়ে- দেশের জাতীয় মসজিদে ১০ জন মুসল্লী নামায পড়ছে, কেবল সেই ছবিটি মনে আঁকুন। আপনার মনে কি কোন ভাবাবেগের উদয় হয়? ফটোগ্রাফারের ছবি তুলেননি, বরং এর মাধ্যমে তিনি ইতিহাস লেখার ভূমিকায় অবতীর্ণ। সেটি আমাদের অনেকেরই বোধদয় হয়না। আগামী প্রজন্ম এসব ছবি দেখে জানতে পারবে এই শতাব্দীর ভয়াবহতা। মানছি, করোনা পরিস্থিতির মাঝে একসঙ্গে এত সাংবাদিকের জড়ো হওয়া নিয়েই হয়তো আপনি প্রশ্ন তুলছেন। সেক্ষেত্রে বলতে চাই, যার কাজটি সে-ই হয়তো ভালো জানে কেন, কোন পরিস্থিতিতে বিপদ জেনেও কিছুটা ঝুঁকি তারা নিয়েছে। এটি অন্য কারো পক্ষে অনুধাবন করা ততটা সম্ভব না।

ফটোগ্রাফারের একটি ছবি- একটি ইতিহাস, একটি কাব্য, মহাকাব্য, উপাখ্যানের জন্ম দেয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় আবেগ কিংবা ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র চিন্তা চেতনার দ্বারা একজন ইতিহাস, কাব্য, মহাকাব্যের রচনাকারীকে থামিয়ে দেবেননা।

 

লেখক: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]