2454

03/29/2024 সব সাংবাদিককে বার্তা দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য

সব সাংবাদিককে বার্তা দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য

চট্টগ্রাম ব্যুরো

৩ নভেম্বর ২০২০ ১৭:২৩

‘অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নেওয়ার পর একটি ঘরে আটকে রেখে দুদফা মারধর করা হয়। নির্যাতনকারীদের মনে হয়েছে পেশাদার সন্ত্রাসী। তবে প্রাণে না মারার জন্য মোবাইল ফোনে বারবার সতর্ক করা হয়। একজনকে নির্যাতনের মাধ্যমে সব সাংবাদিককে বার্তা দেওয়াই ছিল অপহরণকারীদের উদ্দেশ্য’, বলেছেন অপহরণ থেকে ফিরে আসা চট্টগ্রামের স্থানীয় সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার।

গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সরোয়ার অপহরণ থেকে খালপাড়ে ফেলে যাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দেন।

সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার গোলাম সরোয়ার সিটিনিউজবিডি নামে একটি অনলাইন পোর্টালের নির্বাহী সম্পাদক। নগরীর ব্যাটারি গলিতে ভাড়া বাসায় তিনি একাই থাকেন। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা থাকেন চন্দনাইশের গ্রামের বাড়িতে। গত রবিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার বড় কুমিরা গরুর বাজার এলাকার একটি খালের পাড়ে অচেতন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। খবর পেয়ে সাংবাদিক জুবায়ের সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন তাকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বর্তমানে গোলাম সরোয়ার হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। তবে সীতাকুন্ডে জ্ঞান ফেরার পর উপস্থিত লোকজন দেখে আতঙ্কিত গোলাম সরোবার বারবার বলছিলেন- ‘ভাই আমি আর নিউজ করব না। আমাকে ছেড়ে দেন।’

গোলাম সরোয়ার নিখোঁজ হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার রাতে সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান জুবায়ের সিদ্দিকী কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ওই সাংবাদিক। কিন্তু গোলাম সরোয়ার বলছেন, বুধবার রাতেই নগরীর ব্যাটারি গলির মুখ থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল।

সীতাকুন্ড থেকে গাড়িতে করে চমেক হাসপাতালে নেওয়ার পথে গোলাম সরোয়ারের কাছ থেকে তথ্য নেন কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন। পাশে ছিলেন জুবায়ের সিদ্দিকী। তখনকার কথা জানিয়ে সাংবাদিক জুবায়ের বলেন, ‘সরোয়ারকে ওসি বলেছেন- সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বুধবার রাত ১১টায় আপনাকে জিইসি মোড়ে দেখা গেছে। জবাবে সরোয়ার বলেন- সেখান থেকে একটি প্যান্ট ও গেঞ্জি কিনি। পরে স্ত্রীর জন্য আরও কিছু শপিং করে রাত ১২টার দিকে ব্যাটারি গলির মুখে আসি। সেখান থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত যেতে গাড়ি খুঁজছিলাম। তখন একটি মোটরসাইকেল এসে আমাকে পেছনে বসার জন্য বললে উঠে বসি। মোটরসাইকেল চলতে শুরু করলে চালককে বলি- আপনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, কোথায় যাব সেটাও তো জিজ্ঞেস করলেন না। তখন চালককে শাহ আমানত ব্রিজে যেতে বলে ১০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করি। কিছুদূর যাওয়ার পর মোটরসাইকেল চালক গতি কমিয়ে ফেলেন। তখন কালো লম্বা একজন হঠাৎই পেছনে বসে পড়েন এবং আমাকে একটা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দেন। এর পর আমি আর কিছুই জানি না। অনেকক্ষণ পর অনুভব করতে পারি, আমি একটা অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে আছি। ওই গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ঘরে। সেখানে ফ্লোরে রাখা হয়।’

সরোয়ার বুধবার নিখোঁজ হলেও জিডিতে বৃহস্পতিবার উল্লেখের বিষয়ে জুবায়ের সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি শুনেছিলাম বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্ধারের পর এখন সরোয়ার বলছে, তাকে আগের রাতেই (বুধবার) তুলে নেওয়া হয়েছিল।’ গোলাম সরোয়ার জানিয়েছেন, জিম্মি অবস্থায় তাকে সার্বক্ষণিক চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে, কানে হেডফোন জাতীয় কিছু গুঁজে দেওয়া হয়। তবে এর পরও তাকে মারধরের সময় চারজনের উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি তাদের কিছু কথোপকথন শুনেছেন। পাশাপাশি তুলে নেওয়ার পর যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে ট্রেন চলাচলের আওয়াজ শুনেছেন তিনি।

সরোয়ার বলেন, ‘তারা আমাকে দুদিন মারধর করেছে। আর নিউজ করবি কিনা বল- এটা বলেই মারধর করত। শুধু একটাই কথা- আর নিউজ করবি কিনা বল। চামড়ার বেল্ট, তক্তা-জাতীয় কিছু দিয়ে মারধর করত। আমার পুরো শরীর ব্যথা। ভাত খেতে দেয়নি। হাতে একটা পাউরুটি আর পানি দিত কেবল।’ কোন নিউজের জন্য মারধর করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা করতে পারছেন কিনা জানতে চাইলে সরোয়ার বলেন, ‘সেটা তারা বলেনি। শুধু বলত- আর নিউজ করবি কিনা বল? তোদের সাংবাদিকদের কোনো নিরাপত্তা নাই, তোরা কী করতে পারবি?’ নির্যাতনকারী এবং তাদের কথোপকথনের বিষয়ে গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘তারা চারজন ছিল। একজন চট্টগ্রামের ভাষায়, অন্যরা ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলত। কথাবার্তা ও মারধর দেখে মনে হয়েছে তারা পেশাদার। আমাকে দুদিনে মাত্র দুবার মেরেছে। তারা টেলিফোনে কথা বলেছে- স্যার রাখব নাকি ফেলে দেব? প্রত্যুত্তরে শোনা যায়- ফেলতে হবে না, তারে দিয়ে অন্যদের হুমকি দেওয়া দরকার। সে ত্যানাফাডা সাংবাদিক, তাকে কেন মারবি? তারে আনা হয়েছে সে বেশি উড়ছে সে জন্য। তারা অনেক উচ্চস্বরে কথা বলত। আর মুক্তি দেওয়ার আগে জোর করে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সরোয়ার জানান, চার রাত ঘুমাতে পারেননি। এ ঘটনায় তিনি মামলাও করতে চান না।

আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার ব্যুরোপ্রধান জুবায়ের সিদ্দিকী বলেন, ‘বড় কুমিরা এলাকায় স্থানীয় লোকজন যখন তাকে পায়, তখন সরোয়ার আমার নাম ও মোবাইল নম্বর সঠিকভাবে বলেছে। আমি এবং ওসি মহসীন সাহেবের কাঁধে ভর দিয়ে হেঁটেই সে গাড়িতে উঠেছে। হাসপাতালে ঢোকার সময়ও হেঁটে ঢুকেছে। তাকে পেটানো হয়েছে। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন শরীরে খুব বেশি দেখিনি।’

সরোয়ারের বক্তব্যসহ সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার নোবেল চাকমা বলেন, ‘গোলাম সরোয়ার এখনো চিকিৎসাধীন। আমরা তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করব। তিনি মামলা করলে তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে।’

এদিকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে অবর্ণনীয় নির্যাতনের ঘটনাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে আরও একটি হুমকি বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর তাকে খুঁজে পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করলেও, নির্যাতনে অর্ধমৃত ও অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় তাকে ফিরে পাওয়াকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মানতে নারাজ সংস্থাটি। অবিলম্বে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে টিআইবি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের নিখোঁজ হওয়া এবং নির্যাতনের পর আধামরা অবস্থায় তাকে খুঁজে পাওয়া মোটেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং মুক্ত সাংবাদিকতা তথা স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে চলমান হুমকি, ভয়ভীতি ও নির্যাতনের নিষ্ঠুর ধারাবাহিকতা মাত্র।

তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী উদ্ধারকালে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের আর্তনাদ ‘ভাই, আমাকে মাইরেন না, আমি আর নিউজ করব না’- শুধুই নির্যাতনে অপ্রকৃতস্থ অসহায় ব্যক্তির স্বগোক্তি নয়, বরং সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকের ওপর নির্যাতন এবং সাহসী সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধের ভয়াবহ মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রমাণ। গণমাধ্যমের সার্বিক অবস্থার প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটে উঠেছে গোলাম সরোয়ারের এই আর্তনাদের মধ্য দিয়ে!

ড. জামান বলেন, নিয়মিত বিরতিতে সাংবাদিক নির্যাতন এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে হামলা-মামলার ঘটনা ঘটলেও কঠোর আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে যথোপযুক্ত শাস্তির দৃষ্টান্ত কার্যত অনুপস্থিত, যা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। বরং এ কথা বলাও অত্যুক্তি হবে না যে, মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতা বিষয়ে সরকারের বারবার উচ্চারিত কথামালা শুধুই ‘রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা’ মাত্র!

‘স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদের জেরে সরোয়ারকে অপহরণ ও নির্যাতন করা হয়ে থাকতে পারে’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সরোয়ারের সহকর্মীদের এমন আশঙ্কার সূত্র ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের আরও বেশকিছু ঘটনার উদাহরণ আছে, যার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা বিচারের দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই না। তা হলে কি আমরা ধরে নেব যে, সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলা ও নির্যাতন-নিপীড়ন, এমনকি অপহরণ-গুমের মতো ঘটনাও সরকার, তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা গুরুত্বসহকারে দেখছেন না।

তিনি বলেন, আমরা আতঙ্কিত বোধ করছি, যখন দেখতে পাই সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং সে কারণেই স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। প্রভাবশালীদের অবৈধ স্বার্থ সুরক্ষা এবং তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশে বাধা সৃষ্টিতেই কি তা হলে এসব ঘটছে?

ইতিপূর্বে নিখোঁজ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান না করে উল্টো নিজ দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দৃশ্যত বানোয়াট মামলায় তাকে গ্রেপ্তার এবং অমানবিকভাবে হয়রানির উদাহরণ টেনে ড. জামান আরও বলেন, একজন মানুষ নিখোঁজ হলে যেখানে রাষ্ট্র তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে বিষয়ে ত্বরিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঘটনার মূল উদ্ঘাটন করার কথা, সেখানে এক ধরনের ঐচ্ছিক ব্যর্থতাই নিয়মিত উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]