15345

04/20/2024 যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক

যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক

উপ-সম্পাদকীয়

১৫ মার্চ ২০২৩ ২০:২৮

অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) তথ্য মতে, ফিলিস্তিন ছাড়াই বিশ্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ৫৭টি। এর মধ্যে ধর্মীয় দিক থেকে শিয়া-সুন্নি মতবাদ নিয়ে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ রয়েছে তা অন্যদের মধ্যে নেই। কিন্তু এই শিয়া-সুন্নি ধর্মীয় দ্বন্দ্ব সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বিরোধ কিংবা দ্বন্দ্বের মূল কারণ নয়।

ইসলামী ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী ইরানিরা সৌদি আরব, আমিরাত, কুয়েত, কাতার ও বাহরাইনে রাজতন্ত্র মেনে নিতে মোটেও রাজি নয়। অন্যান্য মুসলিম দেশ এ প্রশ্নে সৌদি বা আরব জাহানের সঙ্গে ধর্মীয় বা রাজনীতিগতভাবে এখনো তেমন কোনো বিরোধে লিপ্ত হয়নি।

সর্বোপরি সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বিরোধের মূল কারণটি হচ্ছে ইয়েমেনকে নিয়ে। ইয়েমেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিয়া ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে, যা ইরানের অত্যন্ত কাছাকাছি। বর্তমানে ইয়েমেনের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন প্রতিবেশী সৌদি আরব সমর্থিত এক সুন্নি শাসক, যা ইরানকে সৌদিদের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত যুদ্ধ কিংবা সংঘাতে লিপ্ত করেছে।

ইরান ইয়েমেনের শিয়াপন্থী হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন করে। এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ইরান সামরিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া ইরান সরকার ইয়েমেনের জনগণকে অর্থ ও খাদ্য সাহায্য দিয়ে থাকে। এটি লুকানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। কারণ ঘটনা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে।

ইয়েমেনে কয়েক বছর ধরে সৌদি ও ইরানপন্থী সরকারের মধ্যে এক ‘প্রক্সিওয়ার’ চলছে, যা অবসানের বা সমাধানের কোনো লক্ষণ নেই। এরই মধ্যে সৌদি আরবের তেল স্থাপনা ও অন্যান্য স্থানের ওপর বিদ্রোহী হুতিরা কয়েক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার সরবরাহ এসেছে ইরান থেকে। এমন অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ এখন একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওপরে উল্লিখিত এমন একটি পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলছে না, তেমন নয়। কারণ সৌদি তেল স্থাপনা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো রক্ষার জন্য তাদের প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এ ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র এক কদম এগিয়ে এলে তার সঙ্গে থাকে অসংখ্য শর্ত।

এর মধ্যে জ্বালানি তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ইউরোপসহ পশ্চিমাজগতে তেল, গ্যাসসহ জ্বালানি সরবরাহ পর্যাপ্তভাবে বৃদ্ধির জন্য সৌদি ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সৌদিরা পাবে নিরাপত্তা, অস্ত্রশস্ত্রসহ অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

কিন্তু জ্বালানি তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হলে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের সম্মতি ছাড়াও প্রয়োজন হবে নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধির সক্ষমতা, যা এই মুহূর্তে সৌদি আরবের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের মধ্যে সীমিত রয়েছে। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে একতরফাভাবে কিছু করতে গিয়ে সৌদি আরব রাশিয়ার রোষানলে নিক্ষিপ্ত হতে চায় না। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের রয়েছে সামরিক ও অসামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপকভিত্তিক সমঝোতা।

নিজেদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে নির্বিঘ্ন করতে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও সৌদি আরব ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে বিভিন্ন নিরাপত্তাবিষয়ক চুক্তি ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা কুয়েতও পিছিয়ে নেই।

নাকের ডগায় নিরাপত্তার মুলা ঝুলিয়ে ইহুদিবাদী ইসরায়েল সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ করুক কিংবা সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করুক, সেটি ইরান, চীন ও রাশিয়া মনে-প্রাণে চায় না। তারা চায় ইয়েমেন সমস্যার একটি ন্যায়সংগত সমাধান হোক, সৌদি ও হরমুজ প্রণালির অন্য পারে ইরান নিরাপদ থাকুক এবং বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার তাঁবেদার ইসরায়েলের প্রভাব-প্রতিপত্তি না বাড়ুক। ইরান ও সৌদি আরবের কাছে চীন ও রাশিয়ার নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো প্রস্তাবই বোধগম্য না হওয়ার মতো নয়।

বিগত কয়েক মাসে মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। বিষয়গুলো কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার মধ্যে একটি হচ্ছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বহুল আলোচিত সৌদি আরব সফর। সেই সফর সৌদি আরবের নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চীন যৌথভাবে সৌদি আরবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ থেকে যুদ্ধবিমান এবং আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদারের প্রস্তাব দিয়েছে। তা ছাড়া চীন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বিনিয়োগ প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। চীন ও সৌদি আরব উভয়েই শি চিনপিংয়ের সেই সফরকে অত্যন্ত সফল বলে উল্লেখ করেছে। কারণ শি যুক্তরাষ্ট্রের বহু যুগের দুর্ভেদ্য প্রভাববলয়কে ভেদ করে মধ্যপ্রাচ্যে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন, সেটিই চীনের এক মহাসাফল্য।

অন্যদিকে আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, গত মাসে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির চীন সফর। দুই দেশের সামরিক, বাণিজ্যিক ও বৃহত্তরভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে সেই সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধিকে রোধ করার দিক থেকে সেই সফর অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে। তবে চীন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের কূটনৈতিক সফরগুলো যে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে তা হলো সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষমূলক অবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করা।

চীন এরই মধ্যে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তাতে আগামী দু-এক মাসের মধ্যে দুই দেশেরই দূতাবাসগুলো চালু হতে পারে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ইয়েমেন সমস্যা সমাধানে চীন তার মধ্যস্থতার কিছুটা আভাস দিয়েছে।

বর্তমানে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সংঘাতের মূল বিষয় হিসেবে ইয়মেনকেই শনাক্ত করা হয়েছে। সেই সমস্যা, তা যত জটিল ও স্পর্শকাতরই হোক না কেন, সমাধানের মধ্যেই দুই দেশের শান্তির সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ একটি ধর্মীয় বিষয়। সেটি নিয়ে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে আক্রমণাত্মক অবস্থা বিরাজ করা যুক্তিযুক্ত নয় বলে ওয়াকিফহাল মহলের ধারণা।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ নিয়ে এত দিন ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বিভিন্নভাবে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের একটি পরিস্থিতি অত্যন্ত উসকানিমূলকভাবে জারি রেখেছিল, যা উল্লিখিত দেশ দুটির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছলে অনেকখানি নিরসন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিভিন্ন অজুহাতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল তাতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প তেল আবিব থেকে তাদের রাজধানী জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়া এবং অধিকৃত গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি দখলদারি নিশ্চিত করে ইহুদিবাদীদের সন্তুষ্ট করেছিল। তাতে শুধু পরাধীন ফিলিস্তিনিরাই নয়, ফুঁসে উঠেছিল সমগ্র মুসলিম জাহান। এ অবস্থায়ও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল ইহুদিবাদী ইসরায়েলের তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন এলেও অর্থাৎ রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জায়গায় ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্থলাভিষিক্ত হলেও ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে যায়নি ওয়াশিংটন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখনো সেই আগুন নিয়ে খেলছেন।

ওয়াশিংটন ইসরায়েলের প্ররোচনায় এখনো বলে যাচ্ছে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে। আর এর পাশাপাশি এত দিন সৌদি আরব, তুরস্ক, এমনকি মিসরও বলে আসছিল যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করলে তারাও অবিলম্বে তৈরি করবে বোমা। এ ধরনের উসকানি তারা কোথায় পাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়।

মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এখন হন্যে হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রতিভূ ইহুদিবাদী ইসরায়েল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব, তুরস্ক ও মিসর ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী মনোভাব এখন টের পেয়ে গেছে। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ সৌদি আরব, তুরস্ক, মিসরসহ অন্যরা এখন ক্রমেই সরে যাচ্ছে মার্কিন প্রভাববলয় থেকে। বর্তমানে পশ্চিমা প্রভাববলয়ের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে চীন ও রাশিয়া। সেটিই এখন মার্কিনিদের মাথাব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ নিয়ে সৌদি আরবও অনেক খেলেছে। শিরশ্ছেদ করেছে শিয়াপন্থী এক খ্যাতনামা মুফতিকে। তার প্রতি উত্তরে তেহরানে সৌদি দূতাবাস আক্রমণ করেছে ইরানিরা। বন্ধ করে দিয়েছে সৌদি দূতাবাস। এখন সেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষেত্রে আবার কিছুটা সুবাতাস বইতে শুরু করেছে।

চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদিদের মধ্যে আবার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তারা এখন আর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও আধিপত্যকে পরোয়া করছে না। নিজের স্বার্থ অন্যের কথায় নয়, নিজেরাই নিজস্ব বিবেচনা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ।

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]