1086

04/29/2024 বাবার সাথে কত না স্মৃতি..

বাবার সাথে কত না স্মৃতি..

মরিয়ম হোসেন সেতু

২১ জুলাই ২০২০ ১৫:৪৯

(১)

আমার আব্বা চাকুরী করতেন বন বিভাগে। বদলী চাকুরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের থাকা হয়েছে।

খুলনায় যখন থাকতাম আব্বা থাকতেন সুন্দরবন। মাসে দু'একবার আসতেন। আব্বা আসলে সব ভাই বোনগুলা আব্বার পিছনে ঘুর ঘুর করতাম। আব্বা বলতো দেখি কে আমার মাথা থেকে পাকা চুল আনতে পারে, একটা চুল এক টাকা। কি যে কাড়াকাড়ি লেগে যেতো। কারেন্ট চলে গেলে সবাই বেলকনীতে চলে যেতাম, আর বায়না ধরতাম গল্প শোনানোর জন্য। আব্বা ভুতের গল্প বলতেন, না হয় গোপাল ভাঁড় এর গল্প। কত যে গল্প শুনেছি আমরা আব্বার কাছ থেকে।

আব্বা মাঝে মাঝে ফ্লোরে উপুর হয়ে শুয়ে পরতেন আর বলতেন দেখি তো কে আমাকে উল্টাতে পারে। কিন্ত আমরা কেউ আব্বাকে উল্টাতে পারতাম না। আব্বার সাথে ক্যারম খেলতাম কিযে ভালো হাত ছিল আব্বার। আর একটা মজার খেলা শিখিয়েছিল আব্বা, ক্যারমের চার দিকে চার টা গুটি থাকত, সবগুলিকে এক পকেটে ফেলতে হবে। এটায় আমি ভালো করতাম। আব্বা সব কিছুতে উৎসাহ দিতেন, আবার শাসনও করতেন অনেক।

একবার ছোট দুই বোন পড়া রেখে ক্যারম খেলছিল, আব্বা পর পর দুইবার বলেছে ক্যারম রেখে পড়তে বসো। ওরা খেলেই চলল। আব্বা রেগে এসে ক্যারমটাকে আছাড় দিয়ে ভেংগে ফেললো। অবশ্য ভেঙে ফেলায় ভালই হয়েছিল, ওটা পুরাতন হয়ে গিয়েছিল.. দুদিন পর নতুন ক্যারম এলো।

স্কুল বন্ধ দিলে আব্বার সাথে সুন্দরবন চলে যেতাম। কাঠের ঘর, উপরে গোলপাতার ছাউনি। সেখানে জোয়ার ভাঠার খেলা দেখতাম। জোয়ার এলে বাংলোর সিঁড়িগুলা ডুবে যেতো। আমরা বড়শি নিয়ে বসে থাকতাম। কতো যে মাছ পেতাম।

একবার এক রেঞ্জঅফিসে গেছি। রেঞ্জটার নাম মনে আসছে না, তো সেখান থেকে কটকা যাবো। স্পীডবোটে আমি, আব্বা, আমার বড় আপা, আমার সেজো বোন আর একজন গার্ড ছিল। যেতে যেতে ভয় ও পাচ্ছিলাম আবার সাহস ছিল আব্বা ছিল বলে। কিছু দূর যেতে আব্বা এমন একটা জিনিস দেখাল তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সাগর আর নদী এক হয়েছে। কিন্ত মাঝে একটা দাগ হয়ে রয়েছে। নদীর পানিটা ঘোলাটে আর সাগরের পানিটা কালচে হয়ে আছে। পাশাপাশি আছে অথচ নদী আর সাগরের মিলন হয় না। সাগরের কালচে পানি দেখে আমার ভীষন ভয় করছিল। আব্বাকে বললাম, আব্বা এখন যদি একটা তিমি এসে আমাদেরকে ধাক্কা মারে কি হবে তখন? আমার কথা শুনে আব্বা বলার আগেই বড় আপা বলে উঠলো ওই বোকা এই সাগরে তিমি আছে নাকি? চুপ থাক। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রইলাম। ইস যদি আসে তিমি।

যাক আবশেষে গন্তব্যে পৌছালাম। কি যে নয়ন জুড়ানো দৃশ্য না দেখলে বুঝানো যাবে না।কটকায় তখন ঝাকে ঝাকে হরিন দেখা যেতো, সেখানে যেয়ে দেখলাম বিশাল এক জাহাজ, তাতে অনেক ফরেনার ছিল। আমরা সবাই একসাথে কটকা ঘুরে দেখলাম।

ফিরে যাবার বেলা আব্বা বলছে, মা তোমরা যাও, ঢাকা থেকে অফিসার আসছে আমি একটু পর আসছি। গার্ড শফিক ভাই খুব ভালো মানুষ। আমাদের একদম ভাইয়ের মতো। ভাইয়া বলল- চলেন আপারা।

এখন তো আমার ভয়টা আরও দ্বিগুণ হলো। আব্বা পাশে নাই, যেতে যেতে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। ভাইয়ার কাছে ছাতা ছিল, সেটা দিয়ে তিনজনে বসে রইলাম কোনমতে।সেই জায়গাটা এলো নদী আর সাগর সাক্ষাত যেখানে হল।

হঠাৎ স্পীডবোট নষ্ট হয়ে গেলো, কিছুতেই আর চলছে না। আমি তো কান্না করেই দিলাম।সেজোটা চুপ ও আমার ছোট, কিন্ত অনেক সাহস ওর। আর বড় আপুও মুখ শুকিয়ে গেলো। এখন কি হবে? চারিদিকে পানি আর পানি। আবার বৃষ্টি হচ্ছে। কিযে গেছে সেদিন, সারাজীবন মনে থাকবে। প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে ছিলাম। তারপর দেখি আব্বা আসতেছে আর একটা স্পীডবোট এ করে, দেখে জানে পানি আসল।

ভাগ্যিস আব্বা থেকে গিয়েছিল, না হলে কি যে হত।

বাবা মানেই মাথার উপর ছায়া। বাবা মানেই শান্তি, বাবা মানেই ভয় কে জয় করা।

(২)

বাবার কথা বলে শেষ করা যাবে না

বাবা আমাদের হিরো। আমরা পড়তাম খুলনার রুপসা স্কুলে। আব্বা যখনি সুন্দরবন থেকে খুলনায় আসতেন, স্কুলে যেয়ে স্যারদের সাথে দেখা করতেন। আমার প্রিয় মরহুম বুলবুল স্যারের সাথে আব্বার খুব ভাব ছিল। আমার আব্বা অনেক হ্যান্ডসাম ছিলেন সেই সময়।আব্বাকে দেখলেই স্যাররা বলে উঠত ওই যে মেজর সাহেব আসছেন।

আব্বা স্কুলে যেতেন তার কারনও ছিল। আমার ছোট দুই বোন লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল, আমার মতো নয় তারা। ছোটটা ফাস্ট গার্ল ছিল। সেজোটা থার্ড হত। আব্বা বুলবুল স্যারকে বলতেন, প্রথম দুই সাময়িকে যেন ওরা প্লেসে না থাকে, ভালো করলেও প্লেসে রাখবেন না। স্যার শুনে অবাক! ভাই কি বলেন? ভাল রেজাল্ট দেখলে আর বেশি পড়বে না। মনে অহংকার চলে আসবে। আপনি বরং ফাইনালে ঠিক রেজাল্ট দিবেন।

আমার আব্বা ছিলেন এমন মানুষ। আর এখন আমরা ছেলে মেয়েদের উপর জুলুম করি। প্লেস থাকতেই হবে, এক নাম্বারও কম পাওয়া যাবে না।

একবার আমরা খুলনা থেকে ট্রেনে বাড়ী যাচ্ছি। তো অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা খেয়াল করলো একটা পকেটমার পাশের একটা লোকের পকেট মেরে দিল। আব্বা চুপচাপ উঠে গিয়ে তার পিছু নিলো, পেছন থেকে তার কলার ধরে ফেললো আর যায় কই বাছাধন দিল এক ঘুসি লাগাইয়া, একঘুসি তেই ব্যাটা কাইত। সবাই ছুটে আসল আব্বা তার কাছ থেকে টাকা গুলা নিলো। কিন্তু যার টাকা সে বেখবর। আব্বা এসে বলছে চাচা আপনার পকেটে হাত দেন। উনি তো টাকা না দেখে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। বিপদে পরে লোকটি জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে যাচ্ছিল কোন এক কাজে। আব্বা সব বললেন উনাকে- আপনার পকেট মেরে দিয়েছিল এই নেন আপনার টাকা। লোকটির কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না।কিন্ত হায় আমার আব্বার হাতটা সেদিন ভেঙে গিয়েছিল। এই হাত নিয়ে অনেক ভুগেছিল আব্বা। তারপর ও আফসোস করেননি আব্বা। তার কথা হল অসহায় লোকটাতো বিপদ থেকে বাঁচল।

যে নিজে পকেটমার ধরে, সেই পকেটমার দু'বার আমার বাবার পকেটই মেরে দিয়েছিল!

আমার বড় আপার প্রথম বাচ্চা বাবার বাড়ীতে হয়েছিল। তখন আমরা কক্সবাজার ঈদগা বলে একটা জায়গা আছে সেখানে থাকতাম। ঈদগার আগে একটা মিশন হাসপাতাল আছে, জায়গার নাম ডুলাহাজরা মালুম ঘাট। কি বিদঘুটে নাম তাই না?

বাসে করে যেতে হয়। তো আপা কে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। আব্বাতো মহা খুশি তার একজন সংগি এলো। নাতনির খবর শুনে আব্বা আম্মা কে বলল, আমি বাসায় যাই, খবরটা সবাইকে জানাই। তখন মোবাইল এর ব্যাবহার ছিল না। আব্বা বাসে উঠেছে কিছুক্ষণ পর টের পেলেন মানিব্যাগ নাই। আব্বা বাসের সবাই কে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি জানি পকেটমার এখানেই আছেন। আজ আমি অনেক খুশি নাতনি হয়েছে আমার। যে পকেট মেরেছেন টাকা রেখে আমার দরকারি কাগজপত্র আছে সেগুলা দিয়া দিয়েন। আব্বা বাস থেকে নামতে কেউ একজন মানিব্যাগটা ছুড়ে মারলো। আব্বা সেদিন শুধুই হেসেছিলেন। এক অবাক কান্ড কি জানেন, আমার যখন প্রথম সন্তান হল, আব্বার ওখানেই হল। একই হাসপাতালে। সেই দিনও সেই একই কান্ড হলো। আমরা এখনো সেই ঘটনা মনে করে হাসি।
এমন কত না স্মৃতি মনে গেঁথে আছে।

যারা এই লেখা পড়ছেন, এখানে অনেকের বাবা মা আছে অনেকের নেই। বাবা মা চিরদিন কার ও থাকে না। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে বাবা মাকে সেভাবে আর কাছে পাওয়া হয় না। যাদের দূরে বিয়ে হয়, মন চাইলেও যাওয়া হয় না বাবা মা কে দেখতে।

বাবা মাকে নিয়ে লেখা অনেকেই পড়তে পারেন না। যাদের বাবা মা নেই তাদের কষ্ট হয়। কিন্ত আমি মনে করি, তাদেরও লেখা উচিৎ।

বাবা মা কিভাবে কথা বলতেন, কিভাবে মানুষের সাথে মিশতেন, তাদের নিয়ে মজার স্মৃতি, কষ্টের স্মৃতি, সব লেখেন। মন হালকা হবে।

আমার বাবা এখন বেঁচে নেই। দুবছর হল বাবা কে হারিয়েছি। কিন্তু আমি বলতে চাই না, বাবা নেই। প্রতিটি মুহুর্তে বাবাকে অনুভব করি। বাবার আদর্শে চলার চেষ্টা করি।

বড় ভালো মানুষ ছিলেন আমার বাবা।

গৃহীনি

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]