1005

05/04/2024 একজন শরীফ মাহমুদের চলে যাওয়া ও আমাদের অনুভুতি

একজন শরীফ মাহমুদের চলে যাওয়া ও আমাদের অনুভুতি

শাহ্ ইমরান

১১ জুলাই ২০২০ ১৬:৩১

শরীফ মাহমুদ প্রবাস কথার এক অবিস্মরনীয় নাম। গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া তার সাথে সরাসরি দেখা হয়েছে এমন মানুষ কম অথচ সবার কত কাছের ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুটাও কত সম্মানের ছিল সেটা যতবার ভাবি ততবারই অবাক হই।

ফেসবুকের মত ভার্চুয়াল জগতে একটা গ্রুপ, সেই গ্রুপে লেখালেখি করা ও লাইক কমেন্টস বিনিময়, কারো কারো সাথে কখনও ম্যাসেন্জারে কথোপকথন এই ছিল সম্পর্কের ভিত্তি।

মানুষ আসলে সম্পর্ক চায় সেটা হোক কাছের বা দুরের।

শরীফ ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে আমার ঘটনা না বললেই নয়। আমার ছোট মেয়ে ওয়ানিইয়া'র জন্ম হলো ১০ তারিখ বিকালে, এদিন সকাল বেলা লিজার পেইন উঠলে তড়িঘড়ি হাসপাতালে এডমিট করলাম, বাচ্চা হবার সময়ে একদিকে আনন্দ আর অস্থিরতা কি ভাবে ভোগ করতে হয় সেটা যারা বাবা মা হয়েছেন তারাই জানেন। লিজাকে এডমিট করার পরেই ইতালী থেকে এম কে রহমান লিটনের স্ট্যাটাসে শরীফ ভাইয়ের আইসিইউতে থাকার খবরে সারা প্রবাস কথা উত্তাল হয়ে গেল। কি যে একটা অস্থিরতা। লিজার পেইন বাড়ছে আমি পাশে বসা, আমার নজর একটু পর পর মোবাইলে, লিজার চোখ এড়ালোনা। লিটন ভাইয়ের সাথে কথা হলো, জুনায়েদ, পিন্টু ভাই, জুয়েল ভাই সবাই একটু পর পর আপডেট দিতে লাগলো।

লিজা সেই পেইনের ভেতরে ও বার বার খবর নিতে লাগলো শরীফ ভাইয়ের। দুর দেশের কোন একজন মানুষ যার সাথে দেখা হয়নি কোনদিন তার জন্য এত মায়া টেনশন অনুভব করা? এটা ই শরীফ ভাই অর্জন করেছিলেন। ওয়ানিইয়া জন্ম নিল সন্ধ্যা ৭ টার দিকে অথচ আমি খুব বেশী উৎফুল্ল হতে পারলাম না। মুন্জুরুল করিমের মেয়ের জন্ম, লিটনের মেয়ের জন্ম নিয়ে আমরা কত হৈ চৈ করেছি আনন্দ করেছি, আমার মেয়ে হলো সবার আনন্দ করবার কথা অথচ মেয়ে হবার খবরটা আমি প্রবাস কথায় পোস্ট দিতে পারিনি, এটাই ছিল আমাদের সম্পর্কের দায়বদ্ধতা। একজনের জন্য আমরা আনন্দ বিসর্জন দিতে জেনেছিলাম, এটাই আমরা।

শরীফ ভাইয়ের মৃত্যু ঘোষনা হলো ১১ তারিখে, দিনটি কি বেদনাময় ছিল সবার জন্য সেটা সবার পোস্ট কমেন্টসে জেনেছেন সবাই।

মানুষের ব্যবহারের ওপরে আর কোন কিছু নেই। শরীফ ভাই চিরকুমার ছিলেন, ভালবাসার মুল্য দিয়েছিলেন বিয়ে না করেই। পরিবারের জন্য বিলিয়ে দিয়ে গেছেন নিজেকে, তার মত প্রেমিক বা সন্তান, বন্ধু বৎসল কজনে হতে পারে?

কত মানুষের মুখে আঞ্চলিক ভাষা শুনি শুনেছি, শরীফ ভাইয়ের মত ভাষা সরল করে মাটির সাথে মিশিয়ে কথা বলা কম শুনেছি।

প্রবাস কথায় আমাকে অনেকে ভালবেসে গুরু বলে ডাকে, এটা আমার জন্য নতুন নয়, পাড়ার খুব কাছের ছোট ভাইরা ও অনেকেই গুরু বলেই ডাকতো আগেও বলেছি আজও বলি, শরীফ ভাইয়ের মতো কেউ গুরু বলে ডাকেনি। ফোন দিলেই টান দিয়ে হাসি মুখে গুরু বলে একটা ডাক দিত। কি সাবলীল তার কথা, কোন ভান নেই, দম্ভ নেই, মন ভিজে যেত। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বকা দিতাম শরীফ ভাই হেসেই যেত।

শরীফ ভাইয়ের খুব শখ ছিল আমাকে দেখবার, বলেছিল ডিসেম্বরে দেশ থেকে ফিরে আমার কাছে আসবে একা একা।

: বোচ্ছেন গুরু ? আপ্নার কাছে আইলে আমারে নিয়া সাগর পাড়ে আর আপনার পাহাড়ে বসাইয়া একখান গান ই কিন্ত শোনাইতে হবে।

: কি গান?

: গুরু আমার গান তো একটাই.... আমি চাইলাম যারে ভবে পাইলাম না তারে, সে এখন বাস করে অন্যের ঘরে।

- আহা কি আকুতি ছিল তার।

চিনিনা জানিনা, কোনদিন দেখিনি অথচ বুকের ভেতরটা কাপিয়ে অনুভব করি। একেই বলে মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করা।

শরীফ ভাই চলে গেছেন খুব ভাগ্য নিয়েই বলতে হবে।

ইতালীর এক ফুলের দোকানে বসে নিজে গন্ধ বিলিয়ে গেছেন বিশ্বময়। তার মৃত্যুতে কাঁদিয়ে গেছেন সবাইকে তার ব্যবহার দিয়ে।

এবছর ইতালীতে তরমুজ খাবার হিড়িক নেই আগামীতে ও হবেনা হয়তো
শরীফ ভাই নেই তো।

ইতালী থেকে কোন লাইভে সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে আর কেউ গাইবেনা... প্রেমের খেলা কে বুঝিতে পারে ও বাতাসী রে।

কি বেসুরো গান গাইতেন শরীফ ভাই। কিশোর কুমারের বিখ্যাত এই গানটা ব্যক্তিগত সুর দিয়ে গেয়ে আসল গানের সুরই ভুলিয়ে দিয়েছিলেন।

একদিন ফোনে তাকে বলেছিলাম...

: শরীফ ভাই আপনি তো হালা বাতাসী র আসল গানের সুরই ভুলিয়ে দিছেন

হে হে হে করে হাসতে লাগলেন

: গুরু আপ্নে কি জ্যালাস? হে হে হে।

আহা শরীফ ভাই। আপনি ভালবেসে নিজ ব্যবহারে সবাইকে জিতে নিয়েছিলেন।

একটা গোপন লোভের কথা বলি, শরীফ ভাইয়ের মতো ভাগ্য নিয়ে মরতে ইচ্ছে করে খুব। পৃথিবীর এক কোনায় বসে মরে যাব কিন্ত এক এক প্রান্তে বসে কাদবে সবাই দোয়া করবে সবাই
অথচ কোন সেলিব্রেটি বা তারকা হবোনা, শরীফ ভাইয়ের মতোই সাধারন থাকবো। কেউ কেউ আমাকে নিয়ে চোখের কোনায় চিক চিক করা জল নিয়ে আমার কথা লিখবে ঠিক যেমন করে এখন শরীফ ভাইকে নিয়ে লিখছি।

এত ভাগ্য সবার হয়না। শরীফ ভাই ভাগ্যবান ছিলেন। এই যে আজও তার স্বরনে ডেনমার্কের মসজিদে আমাদের বাবু ভাই আয়োজন করলেন দোয়া মাহফিল এটাই বা ক'জনের ভাগ্যে থাকে বলেন?

ওপারে ভাল থাকুন শরীফ ভাই। আল্লাহ আপনাকে বেহেস্ত নসীব করুন।

প্রবাস কথা পরিবার আপনাকে স্মরন রাখবে আজীবন।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]