অস্ট্রেলিয়ায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে চায় সরকার
প্রকাশিত:
৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৩৬
আপডেট:
৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:১১
বিগত সরকারের সময়ে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে। দেশটিতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই লক্ষ্যে এশিয়া/প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) গ্রুপের সদস্য অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী বাংলাদেশ।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) ঢাকায় সচিব পর্যায়ের আলোচনা প্ল্যাটফর্ম ফরেন অফিস কনসালটেশনে (এফওসি) বসছে ঢাকা ও ক্যানবেরা। ওই বৈঠকে পাচার হওয়া অর্থ নিয়ে আলোচনার ইঙ্গিত রয়েছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএফআইইউ-এর কাছে তথ্য রয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনেক অর্থ অস্ট্রেলিয়ায় পাচার হয়ছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। ফরেন অফিস কনসালটেশনে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পেতে অস্ট্রেলিয়াকে অনুরোধ করবে বাংলাদেশ। দেশটিতে যে অর্থ গেছে তার ব্যাপারে তথ্য আদান-প্রদান করতে চায় ঢাকা।
ফরেন অফিস কনসালটেশন নিয়ে গত ২৭ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বিগত সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় টাকা পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া এপিজি গ্রুপের সদস্য। সেক্ষেত্রে এপিজির নীতি অনুযায়ী, অর্থ পাচারে একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারে।
সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পেতে এপিজির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমরা সহযোগিতা বাড়াতে চাই। আমরা অনুরোধ করব, যেন তারা আমাদের এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেশনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব ও পশ্চিম) মো. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক প্রথম সহকারী সচিব সারাহ স্টোরি দেশটির পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন।
বৈঠকে নির্বাচন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, কৃষি, ব্লু-ইকোনোমি, জ্বালানি, আইসিটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মানুষে মানুষে যোগাযোগ, অভিবাসন, ভিসা সহজীকরণ, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে সহায়তাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
এ ছাড়া, মানবাধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা সংকট, সফর বিনিময়, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত, কাউন্টার টেরোরিজম, ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনে (আইওআরএ) সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক ও বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ প্ল্যান নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয়ে আলোচনা হওয়ার সুযোগ রয়েছে, আলোচনা হবে। যেহেতু এফওসিতে সব বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা থাকে, তেমনি উভয় পক্ষের কিছু অগ্রাধিকার থাকে। বাংলাদেশের দিক থেকে হয়তো পাচার হওয়া অর্থ ফেরত, বিনিয়োগ চাওয়া, সফর বিনিময়, অভিবাসন বিশেষ করে, অস্ট্রেলিয়ার মাইনিং সেক্টরে দক্ষ কর্মী প্রেরণ ও টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন ট্রেনিং (টিভিইটি) এবং অস্ট্রেলিয়ার কারিগরি ও উচ্চশিক্ষার (টিএএফই) মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হবে।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, অস্ট্রেলিয়া হয়তো মানবাধিকার, নিরাপদ অভিবাসন বিশেষ করে অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশিদের প্রবেশ বন্ধ, ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু, জলবায়ু পরিবর্তন ও ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ প্ল্যানের মতো বিষয়ে গুরত্ব দিতে পারে।
মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, অভিবাস গুরত্বপূর্ণ ইস্যু। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) আছে। অনিয়মিত অভিবাসন চায় না অস্ট্রেলিয়া। এ ব্যাপারে আমরাও তাদের সহযোগিতা করছি। মাইনিং সেক্টরে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিতে আমরা তাদের অনুরোধ করব। পাশাপাশি টিভিইটি এবং টিএএফই-এর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি কথা বলা হবে। এ ছাড়া, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আরও বৃত্তি প্রদান, নিয়মিত অভিবাসন ও ভিসা সহজীকরণের মতো বিষয়ে অনুরোধ করা হতে পারে।
নির্বাচন
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠবে ফরেন অফিস কনসালটেশনে। ঢাকার পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ পাঠাতে অনুরোধ করা হবে। এ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তা বলেন, সব কিছু ঠিক থাকলে ফেব্রুয়াতি জাতীয় নির্বাচন। অস্ট্রেলিয়াকে নির্বাচন প্রস্তুতি সম্পর্কে অবগত করা হবে। বিশেষ করে নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ পাঠাতে অস্ট্রেলিয়াকে অনুরোধ করা হবে।
সফর বিনিময়
১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গফ হুইটলাম বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সবশেষ, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিডনি সফর করেছিলেন। ওই সফরটি পূর্ণাঙ্গা দ্বিপক্ষীয় ছিল না।
এ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তা বলেন, অস্ট্রেলিয়া উন্নত দেশের মধ্যে প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই হিসেবে তাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গেছেন ৭৫ সালে। পরের ৫০ বছরে সম্পর্কের কলেবর বাড়লেও শীর্ষ নেতাদের কোনো রাষ্ট্রীয় সফর হয়নি। ২০১৮ সালে এবং এর আগেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গেছে, কিন্তু সেগুলো বহুপক্ষীয় ফোরামে যোগ দেওয়ার অংশ ছিল। পূর্ণাঙ্গ দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল না।
তিনি বলেন, এবারের বৈঠকে উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময় নিয়ে আলোচনা হবে। এটা খুব গুরত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা গ্লোবাল সামিট অব উইমেন সম্মেলনে যোগ দিতে সিডনিতে সফর করেছিলেন। সবশেষ, গত বছরের (২০২৪) অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং ঢাকায় দ্বিপক্ষীয় সফর করেছিলেন।
নিরাপদ অভিবাসন
চলতি বছরের মার্চে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সই করেছে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া। এই চুক্তির আওতায় অস্ট্রেলিয়ায় অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করে আটক হওয়া বাংলাদেশিদের দ্রুত দেশে ফেরানোর প্রসঙ্গ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ অভিবাসনের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে অস্ট্রেলিয়া সরকার। নৌকা করে বা অন্য যেকোনো অবৈধ পন্থায় কোনো বাংলাদেশি দেশটিতে প্রবেশ করুক সেটি চায় না অস্ট্রেলিয়া। তারা এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলবে।
রোহিঙ্গা ইস্যু
বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) তহবিল বাতিলের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সবেচেয়ে বেশি সহায়তাকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে কাঁটছাটে অন্য দাতা দেশগুলোর ওপর দায়িত্ব বেড়েছে। ২০২৬ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি)-তে অস্ট্রেলিয়া বিগত সময়ের চেয়ে তহবিল বাড়াবে-এমনটাই প্রত্যাশা বাংলাদেশের।
এ বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু তহবিল কমিয়ে দিয়েছে অন্য দাতাদের এগিয়ে আসতে হবে। ২৬-এর জেআরপিতে অস্ট্রেলিয়া যেন তাদের তহবিল বাড়ায় সেজন্য অনুরোধ করা হবে। আর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অস্ট্রেলিয়াকে পাশে চাওয়া হবে।
অন্যান্য প্রসঙ্গ
বৈঠকে মানবাধিকার প্রসঙ্গ তুলবে অস্ট্রেলিয়া। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এবং পরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া তাদের মতামত জানাতে পারে। এ ছাড়া, জাতিসংঘের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে উভয় পক্ষ একে অপরের সহযোতিা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যু বিশেষ করে, ফিলিস্তিন, ইউক্রেনসহ নানা সংকট আলোচনায় আসতে হবে।
সম্পর্কিত বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: