বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১


ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শন

সারা দেশে ১৫৯৫ ভবনের মধ্যে সন্তোষজনক মাত্র ২৪টি


প্রকাশিত:
৪ জুন ২০২৩ ২২:৪১

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৭:২৪

ছবি সংগৃহিত

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেছেন, রাজধানীসহ সারা দেশে ভবন-ইমারাত পরিদর্শন কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস। ১৫৯৫টি পরিদর্শন করা ভবনের মধ্যে সন্তোষজনক ভবনের সংখ্যা মাত্র ২৪টি। বাকিগুলোর মধ্যে ৬৭৪টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৮৯৭টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২৪টি বাদে সব ভবন মালিককে নোটিশ করা হয়েছে।

‘অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা : নাগরিকের মানবাধিকার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক কর্মশালায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।

রোববার (৪ জুন) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ কর্মশালার আয়োজন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, পৃথিবীর সব জায়গায় আগুন নিয়ন্ত্রণ খুবই কষ্টকর কাজ। কানাডায় আগুন জ্বলছে। একটা বনে আগুন লেগেছে, যা গত চার দিনেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি কানাডিয়ান ফায়ার সার্ভিস। আমরা আমাদের ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা আরও বাড়িয়ে বিশ্বমানে উত্তীর্ণ করতে আধুনিকীকরণ প্রকল্প গ্রহণ করেছি। আমরা প্রশিক্ষণ, শিক্ষার ব্যবস্থা করতে চাই। জনগণকে সচেতন করার সব ধরনের কৌশল আমরা প্রয়োগ করতে চাই।

তিনি বলেন, যে করণীয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সচেতনতা। ফায়ার সার্ভিস ইতোমধ্যে বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, মার্কেট, শপিং মল, আবাসিক ভবনসহ সব ক্ষেত্রে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে আইনে। ইউএনডিসি’র ধারা অনুযায়ী, ফায়ার বিগ্রেড ব্যবস্থা রাখা, জরুরি বহির্গমন ব্যবস্থা, ভেনটিলেশন ব্যবস্থা, গ্যাস লাইন সংযোজনে অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, মার্কেটে ঘোলা লাইন, ধূমপান নিষিদ্ধ করা, কয়েল ব্যবহার করা যাবে না। ফায়ার সার্ভিসকে নির্বিঘ্নে কাজ করতে দিতে হবে। বিদ্যমান টিনের ও মাটির চুলা অপসারণ করতে হবে। ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করতে হবে।

ফায়ার সার্ভিসের জন্য সরকারের কার্যক্রমের ফিরিস্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশনের সংখ্যা ছিল ২০৪টি, বর্তমানে তা ৪৯২টি। চলমান কাজ শেষ হলে এ সংখ্যা হবে ৭৩৫টি। পানিবাহিত গাড়ি ছিল ২২৭টি, বর্তমানে তা ৫৮৭টি। ফায়ার পাম্প ছিল ৪৫০টি, বর্তমানে তা ১৫০০টি। অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ছিল ৫০টি, যা এখন ১৯৯টি। এছাড়া ২০০৯ সালে বহুতল ভবনের কাজ করার মতো যেখানে মাত্র একটি ৪৭ মিটারের পুরোনো গাড়ি ছিল, সেখানে বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ কাজের জন্য এখন ২৮টি মইয়ের গাড়ি আনা হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বের সর্বাধিক উঁচু ৬৪ মিটার লেডার সম্বলিত গাড়ি ফায়ার স্টেশনের যান্ত্রিক বহরে যোগ হয়েছে। কোনো ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে এখন ২২তলা পর্যন্ত আগুন নেভানো সম্ভব হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ডিজাস্টারের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খাঁন বলেন, পুড়ে যাওয়ার পর আমরা দৌড়ঝাঁপ করছি। অথচ নোটিশ করা হয়েছিল। আমরা খুব সাংঘাতিক রকম সাকসেস হতে চাই। তবে সেটা ফিন্যান্সিয়াল। এই ক্ষেত্রে আমরা কোনো ধরনের নিয়ম মানতে রাজি নই। ফায়ার সার্ভিস যে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে, বন্ধ করতে বলেছে, এরপরও শুধু লাভের আশায় আমরা বন্ধ না রেখে ব্যবসা করে যাচ্ছি। যে কারণে রিস্ক সোসাইটি তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়নের সমস্যা হলো, সবই আছে কিন্তু জাস্টিস নাই। আমাদের প্ল্যান আছে কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই।

মানবাধিকার কমিশনের সদস্য কাওসার আহমেদ বলেন, দুর্যোগ প্রতিরোধে ২২টি আইন রয়েছে। এর মধ্যে ২০টিই মৌলিক আইন। সংখ্যায় আইন কম নয়। এসব আইনের দুটি দিক– এক লাইসেন্স সংক্রান্ত, আরেকটা হচ্ছে ইন্সপেকশন সংক্রান্ত। আমি তাজরীন গার্মেন্টস আগুনের ঘটনায় কাজ করতে গিয়ে জেনেছি, আমাদের আসলে ইন্সপেকশনে সমস্যা আছে, কাঠামোগতভাবে খুবই দুর্বল। অধিকাংশ ভবনই দুর্বল বা ত্রুটিপূর্ণ। অথচ বছরের পর বছর সেগুলো রয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ভবনের ব্যবহারকারী কিন্তু আইন সম্পর্কে সঠিক ওয়াকিবহাল নয়।

তিনি বলেন, অগ্নিনিরাপত্তায় আইনগুলো সুচারুরূপে প্রয়োগ জরুরি। যারা লাইসেন্স দেন বা ইন্সপেকশন করেন, তাদের জবাবদিহিতা জরুরি। আমরা সেটা কখনো করতে পারিনি। এই ক্ষেত্রে আইনি কাঠামোগত ত্রুটিও রয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি সঠিক না থাকে, তবে সবই ভেস্তে যাবে।

ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপো দুর্ঘটনায় ১৩ ফায়ার ফাইটার মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের মূল কাজ অগ্নিনির্বাপণ করা। এর বাইরেও আমরা কাজ করি। সারা বছর আমরা ১০০০ মহড়া করি।

ফায়ার ডিজি বলেন, প্রতিনিয়ত ইন্সপেকশন করছি। সর্বশেষ শ্যামলীর যেখানে আগুনের ঘটনা ঘটছে, সেখানে গিয়ে জানতে পারি, আমরা সৌন্দর্যের জন্য যেসব জিনিস ব্যবহার করছি, আগুনের সূত্রপাত ঘটছে সেখানে।

তিনি বলেন, আমরা যদি দেশবাসীকে সচেতন করতে পারি তবে অনেক অগ্নিকাণ্ড কমানো সম্ভব। ফায়ার সার্ভিসের বিধির বাইরে যাওয়ার আমার সুযোগ নেই। আমরা যেসব কাজ করি তাতে সর্বোচ্চ তিন বছরের সাজা হতে পারে, যদি সেটা কেউ না মানে। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার আবার দুবছর। আমাদের আবার নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট নেই। অন্যদের সহযোগিতা নিতে হয়। আইনের ফাঁক আছে।

ফায়ার ডিজি দাবি করেন, ১০০ টাকার ২ টাকা যদি আমরা ফায়ার সেফটির জন্য রাখি, তবে অনেক আগুন বন্ধ করতে পারব আমরা। একটা প্রতিষ্ঠানে যদি ১০০ জনে ১৮ জনের ফায়ার সেফটি প্রশিক্ষণ থাকে, তবে তাকে আমরা আদর্শ প্রতিষ্ঠান বলছি। কিন্তু দায়িত্বটা কেউ পালন করছি না। ফায়ার সার্ভিসের কাজটা সব দেশেই কমিউনিটি বেইজ। সরকার শুধু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখেন। বাকিটা করেন কমিউনিটি। আমাদের এখানেও সেটা চালু করতে হবে।

অগ্নিঝুঁকি কমাতে না পারলে উন্নত দেশে পদার্পণ করতে পারব না দাবি করে মো. মাইন উদ্দিন বলেন, সারা দেশে আমাদের মাত্র ২৬৮ জন ইন্সপেকশন কর্মকর্তা আছেন। ১৮ জন নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাকি আড়াইশ, এদের দিয়ে আমরা ইন্সপেকশন করছি, রিইন্সপেকশন করছি। আমার ক্যাপাসিটি যদি না বাড়ে তবে ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও সম্ভব নয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ভূমিকম্পের ব্যাপারে আমাদের উদাসীনতা আছে। ভূমিকম্পের পর বড় দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটে অগ্নিকাণ্ডের। কারণ ঢাকায় যদি ভূমিকম্প হয় তবে ভাবুন কি হতে পারে। বিদ্যুৎ শর্টসার্কিটে, গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ঘটবে। ভাবুন কি ঘটতে পারে ঢাকায়।

মুক্ত আলোচনায় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, আমাদের যেটা করণীয় সেটা করা উচিত। পুলিশের যা করার তা করছে। ৬-৭টা প্রতিষ্ঠান যদি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে তবে অনেক দুর্যোগের ঝুঁকি কমে যাবে। যদি তিতাস দায়ী হয়, তবে এটা নিয়ে বার্গেডিং করতে হবে। নিজ নিজ কাজ বুঝে নিতে হবে। এজন্য রকেট সায়েন্স জানা বা আইনস্টাইন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, গণসচেতনতা কিন্তু বাড়ছে, অনেক প্রতিষ্ঠানই সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছে। পুরান ঢাকায় যেসব ভবন রয়েছে, সেখানে আগুন লাগলে নিয়ন্ত্রণে কাজ করা কঠিন। সেখানে প্রবেশের ব্যবস্থাই তো নেই। এরকম এলাকায় কি করা যায়, তার কিছু পরিকল্পনা থাকা দরকার। আগুন লাগলে কি করতে হবে, সেটার বেসিক প্রশিক্ষণ বা জ্ঞানটুকু ঘরে ঘরে থাকতে হবে। শিক্ষার কারিকুলামে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্যোগ মোকাবিলার পাঠ সংযুক্ত করতে হবে।

মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব নারায়ণ চন্দ্র সরকার, কর্মশালার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কমিশনের পরিচালক কাজী আরফান আশিক। কর্মশালায় প্যানেল আলোচনা পর্বে মডারেটরের ভূমিকা পালন করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top