শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Rupali Bank


অর্থপাচার হয়, বিপিসি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় : হাইকোর্ট


প্রকাশিত:
১৬ জানুয়ারী ২০২৩ ০৭:০০

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ২২:০১

 ফাইল ছবি

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির ৪৭২ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনায় বিপিসির ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির ৪৭২ কোটি আত্মসাৎ করে, বিদেশে পাচার হয়, আর বিপিসি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।

বিপিসির আইনজীবীদের উদ্দেশ করে রোববার (১৫ জানুয়ারি) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

আদালতে বিপিসির পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন ও অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ আজাদ।

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানিতে টাকা আত্মসাৎ ও অনিয়মের কথা স্বীকার করে বিপিসির আইনজীবীরা বলেন, এ অনিয়মের পেছনে দায়ী মঈনুদ্দিন আহমেদ ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ। মোহাম্মদ শাহেদ বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। তবে তিনি করোনার মধ্যে মারা গেছেন বলে জানানো হয়।

এ সময় আদালত বিপিসির আইনজীবীদের উদ্দেশ করে বলেন, তখন কি আপনারা (বিপিসি) নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন? এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানিতে অনিয়ম হয়, অর্থ আত্মসাৎ হয় আর আপনারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমান।

এ সময় আইনজীবীরা বলেন, অনিয়মের ঘটনা নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। এ ঘটনায় কমিটি গঠন করা হয়েছে। মামলা হয়েছে।

তখন আদালত বলেন, অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ যিনিই করুক, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে হবে।

পরে আদালত দুদক ও বিপিসিকে এফিডেভিট আকারে তদন্ত সংক্রান্ত প্রতিবেদন আগামী ২৯ জানুয়ারি আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেন। ওইদিন পরবর্তী আদেশ দেবেন আদালত।

এর আগে গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির ৪৭২ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অনিয়মের ঘটনায় কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চান হাইকোর্ট। অডিটর জেনারেল ও বিপিসির চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে অনিয়মের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন, অডিটর জেনারেল ও বিপিসির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এসব তথ্য জানিয়েছেন।

দ্য ডেইলি স্টারে গত বছরের ৪ নভেম্বর ‘৪৭২.৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বিপিসির সহযোগী প্রতিষ্ঠান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির (এসএওসিএল) ২১ অনিয়মের কারণে সরকার ৪৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) ২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এসএওসিএলের নথি পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানতে পেরেছে।

বিপিসি ও এশিয়াটিক ইন্ডাস্ট্রিজের মধ্যে ৫০-৫০ যৌথ উদ্যোগ এসএওসিএল। প্রতিষ্ঠানটি ইঞ্জিন তেল, যানবাহনের তেল, ডিজেল, বিটুমিন, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস ও ফার্নেস তেল বিপণন ও বিতরণ এবং কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানে জেট ফুয়েল সরবরাহ করে।

এসএওসিএলের নথি পর্যালোচনায় যেসব অসঙ্গতি দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে রয়েছে শীর্ষ কর্মকর্তাদের দ্বারা অর্থ আত্মসাৎ, উচ্চ হার, ওভারটাইম, অনুপস্থিত তহবিল, মামলা-মোকদ্দমা ফি প্রদানে অনিয়ম ও আয়কর অধ্যাদেশ এবং ভ্যাট বিধি লঙ্ঘন।

প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ পরিচালকের একজন ও এর ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি মঈনুদ্দিন আহমেদ এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১-১২ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত মঈনুদ্দিন আহমেদের মালিকানাধীন এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির কাছে এসএওসিএলের বিক্রি করা লুব্রিকেটিং তেলের বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে সংস্থাটির ১৯৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এসএসিওএলের নথিগুলোতে দেখা গেছে, এওসিএল চালানের বিপরীতে চেক সরবরাহ করেছিল। তবে, চেকে উল্লেখ করা অর্থ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়নি। এছাড়া কোম্পানি আইন অনুযায়ী, অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ ধরনের লেনদেন নিষিদ্ধ।

বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে এওসিএলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিএজি বলছে, ‘এটি গুরুতর অনিয়ম।’

২০১১-১২ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত কোম্পানির জন্য এসএওসিএলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অগ্রিমের জন্য কোনো ভাউচার বা চালান সরবরাহ না করেই ৮৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন মঈনুদ্দিন আহমেদ। তিনি ২০১২-১২ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত ২৩ কোটি ১১ লাখ টাকা অগ্রিম হিসেবে তুলে নিয়েছেন। কারণ টাকা তোলার কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। তিনি কখনো এই টাকা ফেরতও দেননি।

সিএজি যখন কোম্পানির কাছ থেকে এই অনিয়মের ব্যাখ্যা চেয়েছিল, তখন তারা বলেছিল যে এটি ছিল লুব-ভিত্তিক তেল, অ্যাডিটিভস ও অন্যান্য কাঁচামাল আমদানির জন্য স্থানীয় ব্যয় ছিল। উত্তরটি সন্তোষজনক না হওয়ায় সিএজি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।

অর্থ তছরুপের দুটি ঘটনায় মঈনুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরইমধ্যে তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং তার ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, এসএওসিএলের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ দিয়ে মঈনুদ্দিন আহমেদ গুলশানে ১২ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় তার স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট এবং ১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা দিয়ে রাজধানীর লালমাটিয়া, উত্তর কমলাপুর, বারিধারা, বসুন্ধরা ও চট্টগ্রামের হালিশহরে ৬টি ফ্ল্যাট কিনেছেন।

এসএওসিএলের চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ৩৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা তুলে সেই অর্থ নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেন মঈনুদ্দিন আহমেদ।

২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যে আমদানি করা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩২৫ ড্রাম বিটুমিন হারিয়ে যাওয়ার কারণে এসএওসিএলের বইয়ে ৬৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঘাটতি রয়েছে।

বিটুমিন ড্রামগুলো চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনির গুদামে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সেখানকার প্রহরী জানান, এসএওসিএলের চাহিদাপত্র দেখেই তিনি সেই পণ্য নিয়ে যেতে দিয়েছেন। তবে গুদামের মালিক এ ধরনের কোনো চাহিদাপত্রের কথা অস্বীকার করেন।

প্রতিষ্ঠানটির কাছে কোনো স্টক রিপোর্ট ছিল না। নিরীক্ষকরা এই ধরনের ঢিলেঢালা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিপিসিকে দায়ী করেন এবং আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য এই বিষয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

২০১৩-১৪ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত লুব-ভিত্তিক তেল ও বিটুমিন আমদানির খাতে এসএওসিএলের অ্যাকাউন্টে আরও ৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার ঘাটতি রায়েছে।

প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ গালফ পেট্রোলিয়াম পিটিই, গালফ পেট্রোলিয়াম পিএলসি, ইউনাইটেড অয়েল কোম্পানি ও ইউনাইটেড পেট্রোকেমিক্যালের নামে নন-অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক ইস্যু করেছিল। চেকগুলোর অর্থ উত্তোলন করা হয়েছিল। তবে, এর বিপরীতে কোনো ভাউচার বা চালান পাওয়া যায়নি। কিছু চেকের পেছনে করা সইয়ে দেখা গেছে, এসএওসিএল কর্মকর্তারা চেকগুলো থেকে অর্থ উত্তোলন করেছিলেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এ অনিয়মের পেছনে দায়ী মঈনুদ্দিন আহমেদ ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ।

এই ২ জন সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা দিয়ে জীবন বিমার প্রিমিয়ামও কিনেছিলেন। এসএওসিএলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেই সেই টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মারা যান শাহেদ। এ বিষয়ে জানতে মঈনুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top