শনিবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৫ই আশ্বিন ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


এক রাতেই বিলীন ঘরবাড়ি


প্রকাশিত:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:৩৮

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:৫৯

ছবি : সংগৃহীত

ষাটোর্ধ্ব শামসুন নাহার ও জাহানারা বেগম, দুজনেই প্রতিবেশী। প্রায় তিন দশক ধরে সুখে-দুঃখে ছিলেন একে অপরের পাশে। কিন্তু কখনো ভাবেননি নদীতীরে একজনের শূন্য ভিটায় এভাবে পাশাপাশি বসতে হবে। মেঘনা নদীর ভয়াল ভাঙন কেড়ে নিয়েছে তাদের বসতভিটা, ঘরবাড়ি ও আশ্রয়। এখন তারা পরিবারসহ খোলা আকাশের নিচে একটি ছোট টং ঘরে মানবেতর জীবন পার করছেন। তারা জানেন না, এখন গন্তব্য কোথায়। শুধু এই দুজন নন, একই দুর্দশায় পড়েছেন প্রায় শতাধিক পরিবার।

এ দৃশ্য এখন মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে ক্ষতবিক্ষত ভোলার সদর উপজেলার বিচ্ছিন্ন কাচিয়া ইউনিয়নের মাঝেরচর গ্রামে। এক সময়ের শস্যভাণ্ডারখ্যাত এই গ্রামটির চার-পঞ্চমাংশ ইতোমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, বাকি অংশও রয়েছে হুমকির মুখে। ভয়াবহ ভাঙন অব্যাহত থাকায় যেকোনো সময় পুরো গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে।

সরেজমিনে জানা গেছে, ৯০ দশকে মেঘনার বুক চিরে জেগে ওঠা কাচিয়া ইউনিয়নের রামদেবপুর, মধুপুর ও টবগী গ্রামে আট মাস আগেও প্রায় ১০ হাজার মানুষের স্থায়ী বাস ছিল। এখন পর্যন্ত ৬টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের মধ্যে ৫টি মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, হুমকির মুখে আছে রামদেবপুর-৪ নামের অবশিষ্ট প্রকল্পটি। নদীতে হারিয়ে গেছে একটি মাটির কিল্লা, দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি মাদরাসা, তিনটি মসজিদ, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, শত শত বসতভিটা, বাজার, রাস্তাঘাট এবং কয়েক কিলোমিটার ফসলি জমি।

ভিটেমাটি হারিয়ে কেউ আশ্রয় নিচ্ছেন নদীতীরে টং ঘরে, কেউ গরুর ঘরের পাশে একচালা চালায় কাটাচ্ছেন দিন। নদী ভাঙনে স্কুল ভবন হারিয়ে ১৭৯ নং উত্তর-পশ্চিম কাচিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস চলছে একটি পরিত্যক্ত সাইক্লোন শেল্টারে। কমিউনিটি ক্লিনিক চলছে বসতবাড়ির ভেতর গড়ে ওঠা অবশিষ্ট মাটির কিল্লায়।

এ যেন ভোলার মূল ভূখণ্ডের চোখের আড়ালে ঘটে যাওয়া এক নির্মম বাস্তবতা।

স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, মাঝেরচরে আগে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ভোটার ছিলেন। প্রতিটি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ছিল ১১০-১৩০টি করে ঘর। প্রকল্পগুলো হলো বারইপুরা-১, রামদেবপুর-২, রামদেবপুর-৩, রামদেবপুর-৫ এবং নতুন রামদেবপুর-৩। সবই এখন স্মৃতি। চর রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা।

নদীতে ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করছেন জেলে মো. কালু ও মেহের নেগার দম্পতি। ৩ ছেলে ও ২ মেয়েকে নিয়ে তারা বসবাস করতেন রামদেবপুর-২ নম্বর আশ্রয়ণ প্রকল্পে। মেহের নেগার বলেন, এক রাইতের মইধ্যে নদী ঘরবাড়ি সব ভাইঙা লইয়া গেছে, কিছুই হরাইতে পারিনাই। আচ্ছুক্কা ঠুস ঠুস কইররা ঘর ভিটার মাটি চাকা ধইররা নদীতে পরছে। নদী আমাগো সব লইয়া গেছে।

আবার অন্যের ভিটায় আশ্রয় নেওয়া জেলে আবু তাহেরের স্ত্রী জাহানারা বেগম বলেন, স্যার, এই মেঘনা নদী আমাগো সব লইয়া গেছে। এহন খোলা আকাশের নিচে থাইকা আছি। ঘর-দুয়ার হরাইতে পারিনাই। রাইতকা নদী ঝাপায় ঝাপায় সব ভাইঙা লইয়া গেছে। টাকা পয়সা নাই, ঘরদুয়ার করতে পারিনা।

জেলে মো. সেলিম বলেন, ঘরটা লইয়া ছিলাম, নদী ঘরের লগে আসার পর ভাইঙা সরায়ে আনছি। এখন এইখানে টং পাইততা আছি। এদিকে-ঐদিকে কোনো ঢালকুল নাই, জায়গা জমি নাই, অনেক বিপদে আছি।

বারইপুর গ্রামের অবশিষ্ট সরকারি মাটির কিল্লার আশপাশে দেখা গেল অর্ধশতাধিক পরিবার টিনের টং ঘরে বসবাস করছে। এই আশ্রয় কেন্দ্রের দূরত্ব নদী থেকে মাত্র ১০০-১১০ মিটার। যেকোনো সময় বিলীন হতে পারে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সরকারি স্থাপনাও।

মাটির কিল্লার ভেতরে থাকা আকলিমা ও রাবেয়া বলেন, এইখানে ২০টি পরিবারের থাকার মতো জায়গা নেই, তার পরও শতখানেক পরিবার আমরা এইখানে আছি। সন্তানদের নিয়ে থাকতে অনেক কষ্ট হয়। যাওয়ার জায়গা নেই।

কৃষক মো. স্বপন ও আবুল হাসেম বলেন, প্রতিবছর মাঝেরচরের জমিতে ক্যাপসিকামসহ নানা বিদেশি সবজির বাম্পার ফলন হতো। ভোলা ছাড়িয়ে বরিশাল ও ঢাকায় তা সরবরাহ করতেন। এখন চোখের সামনে ফসলি জমি নদীতে হারিয়ে গেছে। হাতে রয়েছে সামান্য জমি।

মো. বিল্লাহ হোসেন ও মো. সালাউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, চর রক্ষায় কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মেঘনার পেটে গেছে ৫টি আশ্রয় প্রকল্প, একটি মাটির কিল্লা, ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদরাসা, ৩টি মসজিদ, ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও হাজারো বসতঘর। পুরো চরই এখন বিলীনের পথে।

রামদেবপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. মাকসুদুর রহমান জিলাদার বলেন, এইখানের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা ছিল আমাদের ক্লিনিক। দুঃখের সাথে বলতে হয়, নদী ভাঙনে ক্লিনিকটি বিলীন হয়ে গেছে। পরে অন্য একটি ঘরে স্বাস্থ্যসেবা চালালে সেটিও হারিয়ে যায়। এখন মাটির কিল্লার ভেতরে বসে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

শুধু শামসুন নাহার, জাহানারা বেগম, মেহের নেগার, জেলে সেলিম, আকলিমা, রাবেয়া কিংবা স্বপন, হাসেম, বিল্লাল বা সালাউদ্দিনই নন এই চরবাসীর একটাই দাবি, অবশিষ্ট অংশ রক্ষায় দ্রুত জিওব্যাগ বা সিসি ব্লক বসানো হোক এবং বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হোক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলা পানি উন্নয়ন বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জিয়া উদ্দিন আরিফ বলেন, এখন বর্ষা মৌসুম চলছে, নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা অবগত আছি। মাঝেরচরে পরিদর্শন করেছি এবং প্রকল্প গ্রহণের জন্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top